রংপুরে আমনের বাম্পার ফলন: চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্তের সম্ভাবনা
Published : ০১:৫৮, ১০ নভেম্বর ২০২৪
এক সময় মঙ্গাকবলিত এলাকা হিসেবে পরিচিত থাকলেও এখন শস্য ভান্ডার বলে খ্যাত রংপুরে চলতি মৌসুমে আমন ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রাও ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে।
আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার জেলার চাহিদা মিটিয়ে প্রায় সাড়ে ৩ লক্ষ মেট্রিক টনেরও বেশি আমন ধানের চাল উদ্বৃত্ত থাকবে বলে আশা করছেন জেলার কৃষি বিশেষজ্ঞরা। উদ্বৃত্ত চাল অন্য জেলার চালের চাহিদা মেটাতেও সক্ষম হবে।
মাঠে কৃষক ও বর্গা চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চড়া সুদে দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে সার ও কীটনাশক ও সেচসহ বিঘা প্রতি অতিরিক্ত টাকা খরচ হয়েছে। ফলে তারা খুব একটা লাভবান হতে পারবেন না।
খাদ্য বিভাগ কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান ক্রয় না করে বড় ব্যবসায়ীর কাছে চাল ক্রয় করা সিদ্ধান্তের কারণে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এতে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ধানের ন্যায্য মূল্য এবারও পাবেন না বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন।
অথচ কম মূল্যে ধান ক্রয় করে ব্যবসায়ীরা চাল বানিয়ে সরকারি খাদ্য গুদামে বিক্রয় করে কোটি কোটি টাকা মুনাফা করবেন।
কৃষকদের অভিযোগ, তারা ধান বিক্রয় করতে গেলে খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারা নানা অজুহাত দেখিয়ে অনীহা প্রকাশ করলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। শুধু তাই নয়, প্রতিবারই খাদ্য বিভাগ ধান চাল সংগ্রহ অভিযানের নামে গল্প বানায়। কিন্তু প্রকৃত কৃষক আর বর্গা চাষিদের কাছ থেকে ধান ক্রয় করে না।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, রংপুরে চলতি আমন মৌসুমে চালের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল এক লক্ষ ৬৬ হাজার ৭২৩ হেক্টর জমি। লক্ষ্যমাত্রা ছাপিয়ে ধান চাষ হয়েছে এক লক্ষ ৬৬ হাজার ৯৪০ হেক্টর জমি। চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লক্ষ ৯৮ হাজার ৪৪ মেট্রিক টন।
ইতিমধ্যে ধান কাটা ও মাড়াই শুরু হয়েছে। এখন পর্যন্ত রংপুর জেলার ৮ উপজেলায় ৩০ ভাগের বেশি জমিতে ধান কাটা ও মাড়াই শেষ হয়েছে। হেক্টর প্রতি ৩ টনেরও বেশি চাল উৎপাদিত হয়েছে।
কৃষি বিভাগ জানিয়েছেন, এবার আবহাওয়া অনুকূলে ছিল, বৃষ্টি হয়েছে প্রচুর। ফলে কৃষকদের জমিতে এবার খুব বেশি সেচ দিতে হয়নি। ফলে যথাসময়ে জমিতে বৃষ্টির পানি দিয়ে চারা রোপণ এবং অপেক্ষাকৃত কম সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করায় আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে।
রংপুর জেলার মানুষের চালের চাহিদা হচ্ছে প্রায় আড়াই লক্ষ মেট্রিক টন। সেখানে চাল উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ৬ লক্ষ মেট্রিক টনের কাছাকাছি।
ফলে জেলার মানুষের চাহিদা মিটিয়ে দেশের অন্য জেলার প্রায় সাড়ে ৩ লক্ষ মেট্রিক টন চাল সরবরাহ করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা।
রংপুর সদর উপজেলার মমিনপুর, পালিচড়া, পাগলাপীরসহ বিভিন্ন এলাকায় দেখা যায়, মাঠের পর মাঠ সোনালি আমন ধান বাতাসে দুলছে। প্রতিটি গাছে থোকায় থোকায় ধান।
পালিচড়া গ্রামের বর্গা চাষি সালাম বলেন, এবার ইউরিয়া সার পাওয়া গেলেও অন্য সারের দাম অনেক বেশি ছিল। সেই সঙ্গে জমি তৈরি ও চারা রোপণের সময় জমিতে সেচ দিতে হয়েছে। সেই সঙ্গে শ্রমিকদের মজুরি এখন ৫০০-৬০০ টাকা দিতে হয়। তার ওপর দুপুরে এক বেলা ভাত খাওয়াতে হয়।
ফলে ধান উৎপাদনে খরচ এখন অনেক বেশি লাগে। এখন ধান কাটা ও মাড়াই করতে শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। এরপর ধান কাটার পর মাড়াই করা ধান শুকানোসহ অনেক টাকা ব্যয় হয়। সে কারণে ধান চাষ করে যে টাকা খরচ হয় সেটাই ওঠে না।
পাগালাপীর এলাকার কৃষক মমতাজ উদ্দিনসহ অনেকেই বলেন, দাদন ব্যবসায়ী ও এনজিওসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে ধান চাষ করেছেন। এখন বিক্রয় করতে হচ্ছে অর্ধেক দামে।
এক মণ ধান ১৫০০-১৮০০ টাকা বিক্রয় করতে পারলে তারা লাভবান হতেন। হাট বাজারে এখন প্রতি মণ ধান ১২০০ টাকা দরে বিক্রয় করা হচ্ছে।
রংপুর সদর উপজেলার মমিনপুর এলাকার প্রান্তিক কৃষক সোলায়মান আলী, আফছারুল ইসলামসহ অনেকেই বলেন, খাদ্য বিভাগ চাল ক্রয় করার জন্য দাম নির্ধারণ করেছে ৪২ টাকা কেজি। আর ধান ক্রয় করবে ৩০ টাকা কেজি দরে।
কিন্তু তারা কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান ক্রয় না করে মিল ও চাতালসহ বড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ক্রয় করেন। ফলে ওই সব ব্যবসায়ীরা সুযোগ বুঝে ধান ক্রয় করেন নামমাত্র মূল্যে।
বাধ্য হয়ে কৃষকরা কম দামে ধান বিক্রয় করতে বাধ্য হয়। এর ফলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন ব্যবসায়ীরা। আর খাদ্য গুদামে ক্ষুদ্র প্রান্তিক কৃষক ও বর্গা চাষিরা ধান নিয়ে গেলে ক্রয় চান না। তারা মাঠ পর্যায়ে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের মাধ্যমে আসতে বলেন।
তারা বলেন, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তারা তালিকা করার সময় বর্গা চাষিদের নাম তালিকাভুক্ত করেন না। তারা জমির মালিককে খোঁজেন।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, জমির মালিক নয়, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক আর বর্গা চাষিরাই মূলত ধান চাষ করেন। ফলে তাদের নাম তালিকাতেই আসে না। যার কারণে তারা ন্যায্য মূল্য কখনও পান না।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, খাদ্য বিভাগ ধান কাটা ও মাড়াইয়ের পর পরই যদি কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান ক্রয় করেন তাহলে কৃষকরা একটু হলেও লাভবান হতো।
তারা ধান ক্রয় করার ঘোষণা দিলেও এখন পর্যন্ত সরাসরি ক্রয় করছেন না। ফলে যারা ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি তারা দাদন ব্যবসায়ীদের কাছে নেওয়া ঋণের টাকা পরিশোধসহ বিভিন্ন খরচ মেটাতে ধান কাটার পরই ধান বিক্রয় করতে বাধ্য হন।
সে কারণে এ সময় বড় ব্যবসায়ীরা কম দামে ধান ক্রয় করা আশায় ধান ক্রয় করা থেকে বিরত থাকে। ফলে তারা উৎপাদিত ধানের ন্যায্য মূল্য পায় না।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ পরিচালক রিয়াজ উদ্দিন বলেন, চলতি মৌসুমে রংপুরে আমন ধানের ফলন ভালো হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। জেলার খাদ্যের চাহিদা মিটিয়ে প্রায় সাড়ে ৩ লক্ষ মেট্রিক টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে। যা দিয়ে অন্য জেলার চাহিদা মেটাবে।
ধান কাটা ও মাড়াইয়ের পরপরই কৃষকরা জমিতে আলুর বীজ রোপণ করবেন। অনেকে ধান কাটার পর সেই জমিতে আলুর বীজ রোপণ করেছেন। রংপুরে খাদ্য সংকট হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই।
বিডি/ও