কৃষকদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ, ধান চাষ অব্যাহত রাখা
Published : ১১:১৯, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪
দেশে দিন দিন কমছে জমির উর্বরতা। এর ফলে বেড়ে যাচ্ছে চালের উৎপাদন খরচ। কিন্তু কমছে লাভের অংশ। এজন্য ধান চাষ অব্যাহত রাখাই কৃষকদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) চার দিনব্যাপী বার্ষিক গবেষণা সম্মেলনের শেষদিনে একটি গবেষণায় এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।
মঙ্গলবার রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। গত ৭ ডিসেম্বর শুরু হয়েছিল চার দিনের এই গবেষণা সম্মেলন।
সম্মেলনে এ সংক্রান্ত গবেষণায় বলা হয়, ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে শ্রমিকের উৎপাদনশীলতাও। ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত জমির উর্বরতা ছিল ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। তবে ২০০১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত উর্বরতা শক্তি কিছুটা বেড়ে হয়েছিল ৩ দশমিক ৩০ শতাংশ। কিন্তু ২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ব্যাপক কমে উর্বরতা শক্তি দাঁড়ায় শূন্য দশমিক ৪৪ শতাংশে এবং ২০১২ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে উর্বরতা শক্তি কমে হয়েছে শূন্য দশমিক ৩৫ শতাংশ। জমির উৎপাদন বৃদ্ধি নির্ভর করে দক্ষ মানবসম্পদ ব্যবহারের ওপর। তবে সার, কীটনাশক এবং ভূগর্ভস্থ পানির অত্যধিক ব্যবহার পরিবেশের অবনতির দিকে পরিচালিত করে।
‘এগ্রিকালচারাল প্রডাকটিভিটি অ্যান্ড টেকনিক্যাল ইফিসিয়েন্সি ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এ গবেষণা পত্রটি উপস্থাপন করেন বিআইডিএসের রিসার্স ফেলো তাজনোয়ারা সামিনা খাতুন।
এ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক কাজী সালাউদ্দিন। দিনের শুরুতেই বক্তব্য দেন সংস্থাটির মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন। গবেষণাটি তৈরিতে টিমের সদস্য ছিলেন বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক মোহাম্মদ ইউনূস, সংস্থাটির সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর আব্দুস সাত্তাম মন্ডল, সংস্থাটির রিসার্স ফেলো আজরিন করিম এবং রিসার্স অ্যাসোসিয়েটস রিজিওয়ানা ইসলাম।
গবেষণায় বলা হয়, উৎপাদন খরচ বাড়ছে। প্রতিকেজি চালের উৎপাদন খরচ ২০১২ সালে ছিল ১০ টাকা ৫১ পয়সা। সেটি বেড়ে ২০১৫ সালে হয়েছে ১১ টাকা ৬৭ পয়সা, ২০১৮ সালে ১২ টাকা ৮৮ পয়সা। এই কয়েক বছরে উৎপাদন খরচ বেড়েছে ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। অন্যদিকে এক কেজি চাল বিক্রয় করে লাভ হতো ২০১২ সালে ১৬ টাকা ১৭ পয়সা। এছাড়া ২০১৫ সালে ১৬ টাকা ৫২ পয়সা এবং ২০১৮ সালে ১৭ টাকা ৪৮ পয়সা। এক্ষেত্রে গড় লাভ আসে ১ দশমিক ৩১ শতাংশ। মোট উৎপাদন খরচের সঙ্গে বিক্রীত অর্থ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লাভজনকতা হ্রাস পাচ্ছে। কৃষকরা তাদের বিনিয়োগে কম রিটার্ন পাচ্ছেন। কারণ তাদের উৎপাদিত পণ্যের দামের তুলনায় খরচ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই প্রবণতা ধানচাষিদের জন্য একটি ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
গবেষণার ফলাফলে বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদনশীলতা, প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং সম্পদের ব্যবহার সম্পর্কে গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে। জমির উর্বরাশক্তি বাড়াতে মাটির স্বাস্থ্য উন্নত করা জরুরি। উর্বরতা পুনরুদ্ধার করতে নিয়মিত মাটি পরীক্ষা, জৈব সার প্রয়োগ এবং একই জমিতে ফসলের ঘূর্ণন (ভিন্ন ভিন্ন ফসল চাষ) করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বাংলাদেশের কৃষি খাতের মুখোমুখি হওয়া সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে জমির উৎপাদনশীলতা হ্রাস, উৎপাদন খরচের বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতা কমে যাওয়া। তবে এসব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও গবেষণাটি টেকসই উন্নতির পথ দেখিয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, দক্ষ প্রযুক্তির ব্যবহার, মাটির স্বাস্থ্য উন্নয়ন এবং উন্নত সম্পদ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সঠিকভাবে উন্নতি সম্ভব। এছাড়া ছোট কৃষকদের সমর্থন, পরিবেশগত স্থায়িত্ব নিশ্চিতকরণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় টার্গেটেড নীতির ওপর জোর দিতে হবে। সঠিক কৌশল গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের কৃষি খাত এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম হলে খাদ্য নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং আগামী প্রজন্মের জন্য সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
গবেষণায় আরও বলা হয়, কৃষি খামারগুলোর গড় প্রযুক্তিগত দক্ষতা ৭৬ শতাংশ। যেসব খামারে ভালো সম্পদ, বড় আকার এবং উন্নত সংযোগ রয়েছে তারা আরও বেশি দক্ষতা দেখিয়েছে। তবে জমির খণ্ডীকরণ, যা প্রাথমিকভাবে ইতিবাচক ছিল। কিন্তু ২০১৫ সালের পর একটি নেতিবাচক উপাদান হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা উৎপাদনশীলতা এবং দক্ষতা হ্রাস করেছে। ভূগর্ভস্থ পানি সেচ উৎপাদনশীলতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা দীর্ঘমেয়াদিভাবে অস্থিতিশীলতা তৈরি হতে পারে।
‘এগ্রিকালচারাল ক্রেডিট, ট্রেনিং অ্যান্ড ফার্ম হাউজহোল্ড ওয়েলফেয়ার ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক অপর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, যেসব কৃষি পরিবার বিভিন্ন সংস্থা থেকে ঋণ এবং প্রশিক্ষণ পেয়েছে তারা বেশি উন্নতি করতে পেরেছে। যেমন শস্য বহুমুখীকরণ, উচ্চমূল্যের ফসল উৎপাদন এবং উচ্চ আয় অর্জন করতে পারে। এতে কৃষি ঋণ প্রকৃত কৃষক বা ফার্ম যাতে বেশি বেশি এবং সহজেই পেতে পারে সেজন্য তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
বিডি/এন