নারী: পঞ্চনারীর ইতিবৃত্ত

Published : ২২:৫৪, ১৮ এপ্রিল ২০২৫
ড. আব্দুল আউয়াল খানের অন্যতম গ্রন্থ ‘নারী’৷ এই গ্রন্থে লেখক নিজের অভিজ্ঞতার বয়ান করেছেন। মাত্র পাঁচ জন নারীর জীবনের নানাবিধ ঘটনা এখানে স্থান পেয়েছে। এই নারীদের কেউ অতি গুণসম্পন্না, ধৈর্যশীলা, সংগ্রামী ও সহনশীল নারী আবার কেউবা বিপথগামী। সমাজ জীবনে নারীদের চতুর্মুখী বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে লেখক পরোক্ষভাবে সমাজে একটি দিকনির্দেশনা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর৷’ নারীর রূপ মমতাময়ী-প্রেমময়ী তথা কল্যাণময়ী। নারীকে পৃথিবী পরিচিত করিয়েছে কোমল প্রাণের অধিকারী করে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নারীদের পরিবর্তন ঘটছে। নারীরা আত্মনির্ভরশীল হচ্ছে। ভালো-মন্দের ভেদাভেদ বুঝতে শিখছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে শিক্ষার হার। পূর্বের তুলনায় নারীরা এখন বেশি শিক্ষিত। কিন্তু সুশিক্ষা ও অশিক্ষার ফারাক বোঝা যায় আচার-আচরণে। এই গ্রন্থে যে নারীদের জীবনকাহিনি উঠে এসেছে তারা সবাই যে সুশিক্ষার ছায়াতলে আসতে পেরেছে এমন নয়। পুঁথিগত বিদ্যায় শিক্ষার প্রকৃত রূপও নয়। লেখক ড. আব্দুল আউয়াল তাঁর জীবনাভিজ্ঞতা থেকে তুলে ধরেছেন পাঁচ জন নারীর জীবনকাহিনি। তাদের সংগ্রাম, সংঘর্ষ, ভুল পথ আামদের শেষপর্যন্ত ভালো-মন্দের তফাত সম্পর্কে সচেতন করে।
এই গ্রন্থের প্রথম কাহিনিতে স্থান পেয়েছে নিপীড়িতা নারী রোকেয়ার কথা। পূর্বের গ্রন্থের মতো এখানেও বাস্তব জীবনাভিজ্ঞতা থেকে লেখক ঘটনাগুলো তুলে ধরেছেন। এজন্য নামগুলো কাল্পনিক ব্যবহার করেছেন। তবে ঘটনাগুলো কাল্পনিক নয়। প্রতিটি নারী এ সমাজে বিদ্যমান চরিত্র। লেখকের অতি পরিচিত। গ্রন্থের প্রথম কাহিনি হিসেবে স্থান পেয়েছে 'নিপীড়িতা নারী রোকেয়া'র জীবন কাহিনি। বেশ হৃদয়বিদারক। একজন নারী তার স্বামীর কাছে কতটা অবহেলিত হলে জীবন-প্রাণ-শ্রম-অর্থ দিয়ে সঙ্গী হওয়ার পরও পুরুষ তাকে আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে! রোকেয়া গরিব বাবা-মায়ের তিন সন্তানের মধ্যে সবার বড়। টানাটানির সংসারে তেমন একটা পড়াশোনা ভাগ্যে জোটেনি। ষোল না পেরুতেই দিন মজুর বাবা এক গরিব ঘরের কুড়ি বছর বয়সী ছেলে জসীমের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেয়। বিত্তহীন হলেও সুঠাম ও সুন্দর চেহারার অধিকারী জসীমের সঙ্গে সংসারে প্রথম পাঁচ বছর বেশ ভালোই কাটে রোকেয়ার। এই পাঁচ বছরে রোকেয়া দম্পতির ঘরে জন্ম নেয় একটি কন্যা (ময়না) ও একটি পুত্র (সাগর)।
আর্থিক সংকট থাকলেও রোকেয়াকে অশান্তি পোহাতে হয়নি কোনদিন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মমাঘাতে অচিরেই জীবনে প্রবেশ করে এক কালো ঝড় হাওয়া। এর আঁচে রোকেয়ার সংসার জীবন তছনছ হয়ে যায়। ভোলার নদী তীরবর্তী এলাকায় ভাঙন ধরে শ্বশুরের ভিটে-মাটি বিলীন হয়ে পথে বসতে হয়। একসময় জীবিকানির্বাহে তাদের মানুষের কাছে হাত পাততে হয়। কিন্তু এভাবে ছয় মাস তারা টিকে থাকলেও গ্রামে থাকার শোচনীয় পরাজয় তাদের শহরমুখী করে। খালি হাতে শহরে জীবন-যাপনের উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়ে রোকেয়া ও জসিম খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। সন্তানদের নিয়ে মাথা গোঁজার কোন ঠাঁই এ পৃথিবীতে তার জন্য নাই! হঠাৎ রোকেয়ার দূর সম্পর্কের এক খালার কথা জসিমকে বলতেই দুজনের বুকের ওপর থেকে হাজারমণী পাথর যেন সরে যায়। এবং তারা রওয়ানা হয় মোহাম্মদপুরের বেঁড়িবাঁধ এলকার বস্তিতে। রোকেয়ার পরিবার এখানেই আশ্রয় নেয়।
রোকেয়া গৃহকর্মীর কাজ নেয় অন্যদিকে জসিমকে ড্রাইভিং শিখতে উৎসাহী করে৷ একসময় দুজনের উপার্জনে কিছুটা স্বস্তি আসতেই জসিমের পরামর্শে রোকেয়া গ্রামে বাবা-মায়ের কাছে ফেরত যায়। আর এই সুযোগে জসিম অন্যত্র বিয়ে করে সংসার শুরু করে। অন্যদিকে ছেলেও মেয়ে নিয়ে রোকেয়া অথৈ সাগরে পড়ে। কিন্তু তার কর্মোদ্যমী মন শিগগিরই তাকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করে। একসময় গৃহকর্মীর কাজ করে মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করে। কিন্তু সে সুখও কপালে বেশিদিন সহ্য হয়নি। স্বামীর মতো মেয়েও তাকে ধোঁকা দেয়। স্বামীর কাছ থেকে লাঞ্ছনা-বঞ্চনা সহ্য করে সন্তানদের নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে চেয়েছে। স্বামীর কাছ থেকে কোন ভরণপোষণ সে বা তার সন্তান পায়নি শেষপর্যন্ত। রোকেয়ার এই জীবন সংগ্রাম বাঙালি নারীর চিরন্তন রূপ। বাঙালি নারীরা স্বামীর কল্যাণের জন্য সবটা ত্যাগ করতে পিছপা হয় না। কিন্তু জসিমের মতো লোকেরা নারীদের সরলতাকে পুঁজি করে তার জীবনে বয়ে আনে চরমতম দুর্দশা! এ সমাজে রোকেয়াদের অভাব নেই। নিপীড়ন আর নারী দুটো যেন একই সমান্তরাল রেখায় চলে। নারীর জীবনের পুঁজি যে পরিবার সেই পরিবারই তাকে সবটা অবেহলার শিকারে পরিণত করে!
লেখক ড. আব্দুল আউয়াল রোকেয়ার মতো নারীদের চিত্র যেমন তুলে ধরেছেন তেমনই এর বিপরীত চরিত্রও তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী নির্যাতনের হার প্রায় শগভাগ হলেও দিনে দিনে এই চিত্র কিঞ্চিৎ হলেও পরিবরর্তিত হচ্ছে। নারীর পাশাপাশি এ সমাজে বর্তমানে পুরুষও নির্যাতন-নিপীড়নের শিকারে পরিণত হচ্ছে। এই কাহিনি থেকে তার চূড়ান্ত প্রমাণ পাওয়া যায়। শুধু নারীই সমাজে-সংসারে বঞ্চনার শিকার হন এমন নয় পুরুষ নিপীড়নও এখন অহরহ ঘটছে। কোন কোন নারী তার আবহমান রূপকে বিসর্জন দিয়ে ভক্ষকে পরিণত হচ্ছে। নিপীড়ক নারী হেনা কাহিনিতে উঠে এসেছে এক নারীর চূড়ান্ত স্বেচ্ছাচারী রূপ। ভরা সংসার ও সন্তানকে রেখে এক অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন এবং সবশেষে নিজের চূড়ান্ত পরিণতি হেনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ব্যাংকার রাজুর পদন্নোতিতে একদিকে অফিসে প্রতিদ্বন্দ্বী শত্রুদের ষড়যন্ত্র অন্যদিকে হেনার অতিরিক্ত সম্পদ-পতিপত্তি-পাওয়ারের নেশা তাকে একসময় পশুতে পরিণত করেছে। রাজুর অফিস সহকর্মীদের সঙ্গে হাত করে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে হেনা। শেষমেশ স্বামীকে ব্যাংকের মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত করে করাগারে পাঠাতেও দ্বিধা করেনি! হেনা চরিত্র খুব একটা অপরিচিত নয় এ সমাজে। সমাজে ভালো-মন্দ দুদিকই আছে। কিন্তু কে ভালো বা সততার সঙ্গে জীবনযাপন করবে আর কে হেনার মতো অবক্ষয়ের অংশীদার হবে এটা ব্যক্তির নিজস্ব বিষয়। তবে সমাজে যেন আর একটিও হেনার জন্ম না হয় এটাই চাওয়া।
'সহনশীলা নারী তানিয়া' এখানে লেখক আরেকজন সহনশীল নারীর জীবন বর্ণিত করেছেন। নারীদের অবদান একটি পরিবারকে সুগঠিত করতে পারে আবার ধ্বংস করতেও সমান ভূমিকা রাখে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক জাহেদের স্ত্রী তানিয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার জন্য বাইরের দেশের পিএইচডি ডিগ্রি সক্রিয় ভূমিকা রাখে তাই জাহেদও এ ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে ওঠে। একসময় পরিবারসহ বিদেশে চলে যায় অতঃপর ডিগ্রিপ্রাপ্ত হলে জাহেদ-তানিয়া দেশে প্রত্যাবর্তন করে। কিন্তু তাদের হের মানতে হয় একমাত্র কন্যা সন্তান রেনুর যুক্তির কাছে। সে আর দেশে ফিরতে চায় না। শেষপর্যন্ত জাহেদ দম্পতি দেশে ফিরে আসে। মেয়ের সঙ্গে ক্রমাগত মতভেদ হওয়ায় তাদের দূরত্ব বাড়তে থাকে। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে জাহেদ পদন্নোতি পেয়ে অধ্যাপক হন। কিন্তু একমাত্র মেয়ের সঙ্গে বিচ্ছেদ ও মতভেদ তাদের মানসিকভাবে বিষন্ন করে তোলে। একটি পর্যায়ে জাহেদ মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে চিরতরে বিছানাগত হয়। স্ত্রী তানিয়ার বিনিদ্র সেবা জাহেদকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াসের মধ্যে দিয়ে কাহিনির ইতি টেনেছেন লেখক। সমাজে হেনার মতো কিছু নারীর অবস্থান থাকলেও এর ব্যতিক্রম রয়েছে। নারী মূলত মমতাময়ী। তানিয়া, রোকেয়ারা এ সমাজকে আজও সামনের দিকে অগ্রবর্তী করছে।
‘অদূরদর্শী নারী শাহানা’ কাহিনিতেও নারীর অদম্য সংগ্রামের চিত্র তুলে ধরেছেন লেখক। শাহানার বাবা উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে সে চতুর্থ। শাহানা নিজের পড়ালেখায় যত্নবান ছিল না। বিয়ের পর স্বামী রনজু বহু বুঝিয়ে শিক্ষার ব্যাপারে উৎসাহে করে তোলে এবং অর্নাসে ভর্তি করিয়ে দেয়। কিন্তু শাহানার আগ্রহ কমতে থাকে। তাদের একমাত্র চিন্তা ছেলেকে নিয়ে। রনজু অনুভব করতে থাকে সন্তানেরা শুধু পরীক্ষায় ভালো করছে কিন্তু মানুষ হিসেবে কতটা আত্মপ্রকাশ করছে তার প্রতি শাহানার নজর নেই। ফলশ্রুতিতে গ্রাজুয়েশন শেষ করে ছেলেদের কেউই আর দেশত্যাগে দেরি করেনি। এমনকি বিদেশে লেখাপড়া শেষ করে দেশেও ফেরত আসেনি। রনজু কখনোই প্রবাস জীবনের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেনি বিধায় সন্তানদের ছেড়ে দেশে থেকেছে। এবং মেয়ের ঘরের নাতিদের নিয়ে সময় কাটিয়ে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে কাঙ্ক্ষিত সুখ খুঁজে নিয়েছে। শাহানার অদম্য উৎসাহে একটি পরিবার সঠিক জীবনযাপন বেছে নিতে সচেষ্ট হয়েছে।
‘বুদ্ধিদীপ্ত, দূরদর্শী সফল নারী রোজিনা’ এই কাহিনিতেও নারীর দূরদর্শিতার জয়গান গেয়েছেন লেখক। নিজস্ব অভিজ্ঞতাকে সরাসরি এই কাহিনি নির্মাণের ক্ষেত্রে কাজে লাগিয়েছেন লেখক। রোজিনা-রিয়াজ দম্পতির মধ্যে রোজিনায় বেশি সক্রিয় ছিল। তার স্বামী রিয়াজ বেশ উদাসীনভাবে জীবনযাপন করে। তাই সংসার ও ছেলেমেয়ের সব ভার রোজিনাকেই সামলাতে হয়েছে। এজন্যই মা হিসেবে রোজিনার দূরদর্শিতা ও সহশীলতা অন্যদের থেকে আলাদা। ড. আব্দুল আউয়াল খান কাহিনিগুলো জীবন থেকে তুলে এনেছেন। এই পাঁচ জন নারীর জীবন বিনির্মাণের মধ্যে দিয়ে লেখক নারীদের জন্য একটি বার্তা প্রেরণ করেছেন। হেনাদের মতো নারীরা সমাজ বিগর্হিত কিন্তু তানিয়া, রোকেয়া, শাহানা বা রোজিনার মতো নারীরা এ সমাজের নমস্য।
এনই