‘রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাংকে দুর্নীতি একমাত্র বাংলাদেশে হয়েছে’

‘রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাংকে দুর্নীতি একমাত্র বাংলাদেশে হয়েছে’

নিজস্ব প্রতিবেদক

Published : ১৯:০৭, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪

বিশ্বের ইতিহাসে বাংলাদেশেই একমাত্র রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাংক খাতে দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে। একটি পরিবারের হাতে ৮–৯টি ব্যাংক তুলে দেওয়া হয়েছে। এ খাতকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে আইনি, কাঠামোগত ও পরিচালনগত সংস্কার আনতে হবে। দ্বৈত শাসন বন্ধ করে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় ব্যাংক গড়ে তুলতে হবে। দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে দক্ষ ব্যাংকার গড়ে তুলতে হবে।  মঙ্গলবার  (২৪ সেপ্টেম্বর)  রাজধানীর কাওরানবাজারে  আয়োজিত‘ব্যাংক খাতকে কোথায় দেখতে চাই’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্টজনেরা এসব কথা বলেন।

অনুষ্ঠানের মূল আলোচক বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর ব্যাংক খাত সংস্কারে এরই মধ্যে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ব্যাংক কোম্পানি আইন সংস্কার করা হবে। তবে এ জন্য বারবার না গিয়ে কোথায় কি সমস্যা আছে সব চিহ্নিত করে একবারে যাওয়া হবে। বিভিন্ন নীতি কাঠামো সংস্কারের জন্য তিনটি টাস্কফোর্স গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এরই মধ্যে ব্যাংক খাত সংস্কারে টাস্কফোর্স কাজ শুরু করেছে। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশসহ তিনটি ব্যাংকে বিশদ পরিদর্শন হবে। কোথায় কে ঋণ নিয়ে গেছে তা বের করা হবে। বাকি দুইটি টাস্কফোর্সের মধ্যে একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক শক্তিশালী করণ এবং অপরটি সম্পদ উদ্ধারে করণীয়সহ বিভিন্ন সুপারিশ তুলে ধরবে।

গভর্নর বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা এ সময়ে আমাদের অন্যতম লক্ষ্য। এ জন্য আপাতত কোনো টাকা ছাপানো হবে না। রিজার্ভ থেকেও কোনো ডলার বিক্রি করা হচ্ছে না। এতে সুদহার হয়তো কিছুটা বাড়বে। তবে একটা স্বস্তির বিষয় হলো বিনিময়হার অনেকদিন ১২০ টাকায় স্থিতিশীল আছে। এভাবে আগামী জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি হয়তো কমে আসবে। এতে ব্যবসায়ীদের সাময়িক খরচ বেশি হলেও দীর্ঘ মেয়াদি স্থিতিশীলতার জন্য এটা জরুরি। তাছাড়া সুদহার নয়ছয় করে কিংবা রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে আদতে তেমন লাভ হয়নি। বিনিয়োগ বাড়েনি। আবার মূল্যস্ফীতিও বেড়েছে। তিনি বলেন, পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে আলোচনা শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সিঙ্গাপুর থেকে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে সহায়তা চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। 


গভর্নর আরও বলেন, ব্যাংকের বেতন কাঠামো কেমন হবে, কোন ব্যাংকের এমডির বেতন কত হবে, কে কোন দেশে যাবে এসব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ না। বরং সব জায়গায় একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তুলতে হবে।

বৈঠকের অন্যতম আলোচক এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি ও হা–মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ. কে. আজাদ বলেন, ৯ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে মূলধনী যন্ত্রপাতি এনে এখন সাড়ে ১৪ শতাংশ সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে। আবার রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) থেকে ঋণের সুযোগ বন্ধ করা হয়েছে। অথচ বিদ্যুৎ, গ্যাস, বেতন–ভাতা, পরিবহনসহ সব ধরনের খরচ অনেক বেড়েছে। সেখানে পণ্যের দর না বেড়ে কমেছে। এরকম অবস্থা চলতে থাকলে কর্মসংস্থান বাড়বে না। এরই মধ্যে বেশ কিছু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক কারখানা বেতন দিতে না পারায় বিক্ষোভ হচ্ছে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এসব বিষয় দেখতে হবে। প্রতিবছর যে ৩০ লাখ কর্মসংস্থান হয় এর মধ্যে ১০ লাখ যায় বিদেশে, ১ লাখ ২ হাজার মতো সরকারি চাকরি করে। বাকি কর্মসংস্থান হয় বেসরকারি খাতে। গত কয়েক বছরে বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি নেই। ফলে আগামীতে যেন এ খাত সঙ্কটে না পড়ে সেদিকে নজর রাখতে হবে।

এ. কে. আজাদ আরও বলেন, আমাদের রপ্তানি খাত যেন অন্যদের হাতে চলে না যায় খেয়াল রাখতে হবে। কেননা, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত বিনিয়োগ আকর্ষণে পাঁচটি রাজ্যে অনেক ধরনের ছাড় দিয়েছে। আবার বিনিময়হার জনিত কারণে পাকিস্তানের রপ্তানি ১০ শতাংশ বেড়েছে। আমাদের যেখানে সর্বশেষ অর্থবছরে প্রায় ৫ শতাংশ কমেছে। এখন খেয়াল রাখতে হবে মূল্যস্ফীতি কমাতে গিয়ে আমাদের রপ্তানি বাজার যেন অন্যদের হাতে চলে না যায়। কেননা আমরা ২ বিলিয়ন ডলার ঋণের জন্য কত ধরনের চেষ্টা করছি। অথচ সবশেষ অর্থবছরে ২ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি কমেছে। চলতি অর্থবছর হয়তো ৪ বিলিয়ন ডলার কমবে।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে আয়োজিত আরও অংশ নেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, বিএবির ভাইস-চেয়ারম্যান ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মান্নান, ইস্টার্ন ব্যাংকের এমডি আলী রেজা ইফতেখার, সিটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান আজিজ আল কায়সার, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক মনজুর হোসেন, ব্যাংক এশিয়ার চেয়ারম্যান রোমো রউফ চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক রুশাদ ফরিদী, লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের এমডি হুমায়রা আজম, বিআইবিএমের অধ্যাপক শাহ মো. আহসান হাবীব।

এনই

শেয়ার করুনঃ
Advertisement