নারীর সম্ভ্রম বাঁচাতে সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে প্রাণ গেলো যুবকের

নারীর সম্ভ্রম বাঁচাতে সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে প্রাণ গেলো যুবকের

ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি:

Published : ১৬:৫৩, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪

মোন্তাকিম আলিফ (২৫) নামে এক যুবক নারী সহকর্মীর সম্ভ্রম বাঁচাতে ছিনতাইকারীদের সঙ্গে যুদ্ধ করে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। অবশেষে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয় আলিফের।

মঙ্গলবার (২৪ সেপ্টেম্বর) ভোর সাড়ে ৪টার দিকে ঢাকা কুড়িল ফ্লাইওভার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

জানা গেছে, মোন্তাকিম আলিফ রাজধানীর একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকুরী করতেন। অফিসের নাইট শিফট শেষ করে ভোর রাতে এক নারী সহকর্মীসহ বাসায় ফিরছিলেন।

পথিমধ্যে সহকর্মীকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার সময় কুড়িল ফ্লাইওভারের সামনে ৩ জন বখাটে মেয়েটিকে উত্যক্ত করে। এ সময় মোন্তাকিম আলিফ প্রতিবাদ জানালে ছিনতাইকারীদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয়। 

আলিফ ওই ৩ জন ছিনতাইকারীকে মারধরও করে।  ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে আলিফ মেয়েটিকে ঘটনাস্থল থেকে চলে যেতে বলে, যাতে মেয়েটির সম্ভ্রম রক্ষা হয়।

এ সময় ছিনতাইকারীরা আলিফের শরীরে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলােপাতাড়ি আঘাত করে পালিয়ে যায়। পরে আলিফকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলে প্রচণ্ড রক্তক্ষণে তার মৃত্যু হয়।

আলিফের এমন মৃত্যুতে তার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবসহ এলাকাবাসী শোকে কাতর হয়ে পড়েছে।

নিহত আলিফের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার চাড়োল ইউনিয়নের দোগাছি মধুপুর গ্রামে। থাকেন জেলা শহরের টিকাপাড়ায়। 

আলিফের মৃত্যুর খবরে তার বাড়িতে ভিড় করছে আত্মীয়স্বজনরা। তার বাবা জুলফিকার আলী ও মা কহিনুর বেগমকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন প্রতিবেশীরা। উপস্থিত সবার চোখে পানি।

মায়ের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠে চারপাশের পরিবেশ। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলছেন, আমার কলিজার ধনকে আনে দেও। আমার ধনকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখতাম। আহা রে ধনটা কই গেল। 

ভালো করে লেখাপড়া করবে, সেজন্য ঢাকা শহরে ভালো কলেজ ভর্তি করালাম। মাসে মাসে এখন আমি কাকে টাকা পাঠাব। এখন আমি কাকে নিয়ে বেঁচে থাকব। আমাকে একা করে এভাবে চলে যাবি। আমাকে সঙ্গে করে কেনে নিয়ে গেলি না।

মোন্তাকিম আলিফ ২০১৬ সালে ঠাকুরগাঁও সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করে রাজধানীর আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন। পড়াশোনার পাশাপাশি একটি প্রাইভেট কোম্পানিতেও চাকুরি করেন।

একটি মেয়েকে বাঁচাতে আলিফের এমন মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাকে মৃত্যুঞ্জয়ী আখ্যা দিচ্ছেন।

আলিফের বন্ধু মুনিজা হোসেন প্রিথিলা তার ফেসবুকে লিখেছেন, একটা মানুষ নিজের জীবনের শেষ টুকু দিয়ে একটা মেয়ের জীবন বাঁচিয়ে গেলো। আসলে কত বড় মন হলে এবং কতটুকু ভালো মানুষ হলে একজন নিজের জীবনের শেষ সময়েও আরেকজনের জীবন বাঁচায়? কেউ বলতে পারবেন? অনেক রাগ ছিলো আমার প্রতি তোর। মাফ করে দিস আমাকে আলিফ।

শাহারিয়ার জাকির রিম্পু নামে একজন লিখেন, আলিফের জন্য আমরা গর্বিত। ওর বাবা-মাকে কোনোভাবেই সান্ত্বনা দেওয়া যাবে না। প্রিয় সন্তান আলিফকে হারানোর অভাব কেউ কোনো দিনই ওর বাবা-মাকে পূরণ করে দিতে পারবে না। 

কিন্তু আলিফকে নিয়ে আমরা গর্ব করতেই পারি। সেটি হলো, আমাদের  তরুণ, যুবক সমাজ এখনো পুরোপুরি নষ্ট হয়ে, পচে-গলে দুর্গন্ধ ছড়ায়নি। আমরা আশান্বিত হতেই পারি, সমাজে এখনো আলিফের মতো যুবকরা আছে, যারা নিজের সমূহ সর্বনাশ হতে পারে জেনেও মানুষের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ে। একজন নারীকে রাক্ষুসদের হাত থেকে রক্ষ করে।

শ্রাবণী বর্মন নামে নামে আরেক বন্ধু লিখেন, সকাল সকাল এই নিউজটা পেয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেছে। ওর বাসা পার হয়েই আমার বাসা যেতে হতো। সেই সুবাদে আলিফকে রাস্তায় প্রায়শই দেখতাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফোন চাপতে। আলিফ শুধু ছিনতাইকারীর ছুরির আঘাতেই নিহত হয়নি, একজন মেয়েকে তাদের হাত থেকে সর্বস্ব রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হয়েছে।

আলিফের আরেক বন্ধু লিখেছেন, ‘আহ জীবন! আমার সহপাঠী, ঠাকুরগাঁও সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের শুরু থেকে যার সাথে ওঠাবসা, ওরে আজ হারাইলাম। অন্যকে বাঁচাইতে গিয়ে সে নিজে চলে গেল না ফেরার দেশে। আমি বাকরুদ্ধ। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা তোমাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুক।

মানসুরুল হক (বাবু) লিখেন, আলিফের মৃত্যুতে একটি মেয়ে নতুন জীবন ফিরে পেলেও তার মা-বাবা কখনো ভুলতে পারবে না ছেলের এভাবে চলে যাওয়া। তবে মহাকাল সবকিছুকে ধ্বংস করে দিলেও কিছু কর্ম, ত্যাগ, সৃষ্টি কখনো বিলীন হয় না।

বিডি/ও

শেয়ার করুনঃ
Advertisement