দুইবছরে দাম সমন্বয় ৯১ বার, স্বর্ণের বাজারে কেন অস্থিতিশীলতা

Published : ১৪:৩৭, ২২ জানুয়ারি ২০২৫
অতি প্রাচীনকাল থেকেই সম্পদের প্রাচুর্যতা প্রদর্শনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক লেনদেনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বহন করে চলছে স্বর্ণ বা সোনা। বলা হয়ে থাকে, অর্থের স্থায়ী রূপ সোনা। আদিকাল থেকেই এর চোখ ধাঁধানো ঔজ্জ্বল্য, অনন্যসাধারণ দীপ্তি, চাকচিক্য ও রঙের তীব্রতা মানুষকে অভিভূত করে চলেছে। এ কারণেই এই ধাতুটির আকর্ষণ ও মূল্য কখনো শূন্যে নামেনি। কোনো কারণে কমলেও বিশ্বজুড়ে মূল্যবান এই ধাতুর দাম বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। বেড়েই চলেছে সোনার দাম।
বাংলাদেশের বাজারে নতুন বছরের ১৩ জানুয়ারি পর্যন্ত সোনার দাম ওঠানামা না করলেও বিশ্ববাজারে স্বর্ণের মূল্য দুই দফা বেড়েছে।
বিশ্ববাজারে ২য় দফা বাড়লো স্বর্ণের দাম
বড় দরপতনের পর বিশ্ববাজারে ২য় দফায় হঠাৎ স্বর্ণের দাম বেড়েছে। এক দিনের ব্যবধানে প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম বেড়েছে ১৯ দশমিক ৬৬ ডলার। শনিবার (১১ জানুয়ারি) রাত ৮টা পর্যন্ত স্পট মার্কেটে স্বর্ণের দাম অবস্থান করছিল ২ হাজার ২৬৯৮ দশমিক ৯৪ ডলার।
সপ্তাহের হিসাবে, গত ৩০ ডিসেম্বর স্বর্ণের আউন্স ছিলো ২ হাজার ৫৯৯ ডলার। গত সপ্তাহের লেনদেন শেষে ২ হাজার ৬৯৮ দশমিক ৯৪ ডলারে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ, প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম বেড়েছে ৯৯ ডলারের ওপর।
গত ৩০ ডিসেম্বর (সোমবার) বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) দেশের বাজারে স্বর্ণের দাম নির্ধারণ করে থাকে। সংগঠনটির সবশেষ দেওয়া দাম অনুযায়ী, ২২ ক্যারেটের এক ভরি স্বর্ণের দাম ১ লাখ ৩৮ হাজার ২৮৮ টাকা। ২১ ক্যারেটের এক ভরি স্বর্ণের দাম ১ লাখ ৩২ হাজার ১ টাকা। ১৮ ক্যারেটের এক ভরি স্বর্ণের দাম ১ লাখ ১৩ হাজার ১৪১ টাকা। সনাতন পদ্ধতির এক ভরি স্বর্ণের দাম ৯২ হাজার ৮৬৯ টাকা।
সংগঠনটির পক্ষে স্বর্ণের দাম বাড়ানো বা কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন প্রাইসিং অ্যান্ড প্রাইস মনিটরিং কমিটি। এই কমিটির এক সদস্য বলেন, বিশ্ববাজারে যে হারে স্বর্ণের দাম বাড়ছে, তাতে দেশের বাজারেও দাম বাড়ানো লাগবে। এর কোনো বিকল্প নেই। আমার স্বর্ণের দাম বাড়ানো বা কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় আন্তর্জাতিক বাজারের পাশাপাশি স্থানীয় বাজারের ওপর ভিত্তি করে। স্থানীয় বাজারে পাকা স্বর্ণের দাম বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আবার পাকা স্বর্ণের দাম কমলে দাম কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বিশ্ববাজারের দামের চিত্র পাকা স্বর্ণের দামে প্রভাব ফেলে।
নতুন বছরের ১ম দিনেও বিশ্ববাজারে বাড়লো সোনার দাম
এরআগে নতুন বছরের প্রথম দিন সোনার দাম আউন্সপ্রতি বৃদ্ধি পায় ১৮ দশমিক ২৫ ডলার। গত ১ জানুয়ারি (বুধবার) সকালে বিশ্ববাজারে সোনার দাম ছিল আউন্সপ্রতি ২ হাজার ৬২৪ দশমিক ৪৯ ডলার।
বিদায়ী ২০২৪ সাল ছিলো স্বর্ণের সোনালি সময়। বছরজুড়েই এই ধাতুর দাম বেড়েছে। গত এক বছরে এই ধাতুর দাম বেড়েছে ২৬ দশমিক ৫৪ শতাংশ বা ৫৪৬ দশমিক ৬৩ ডলার। তার ধারাবাহিকতায় ১ জানুয়ারি বছরের প্রথম দিনেও বেড়েছে সোনার দাম। সূত্র: ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল ও রয়টার্স
তথ্যানুযায়ী, ২০১০ সালের পর সোনার বাজার ২০২৪ সালে সবচেয়ে ভালো সময় পার করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর ক্রয়, ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা ও মুদ্রানীতির রাশ আলগা হওয়ার কারণে ২০২৪ সালে পণ্যটির দাম বেড়েছে। স্পট মার্কেটে বছরের শেষ দিন সোনার দাম বেড়েছে দশমিক ৪ শতাংশ; প্রতি আউন্সের দাম ওঠে ২ হাজার ৬১৫ ডলারে।
স্বতন্ত্র বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান উইজডমট্রির ম্যাক্রোইকোনমিক গবেষণা পরিচালক অনীকা গুপ্ত বলেন, ‘ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর চাহিদা, মুদ্রানীতির সহজীকরণ সোনার দাম বাড়ায় ভূমিকা রেখেছে। এ ছাড়া এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড কমোডিটি (ইটিসি) ছিল ২০২৪ সালে স্বর্ণের দাম বাড়ার মূল চালিকা শক্তি। ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি ও ফেডারেল রিজার্ভের সুদহার কমানোর ধীরগতির মতো কিছু চাপ সত্ত্বেও সোনার দাম ২০২৫ সালে আরও বাড়তে পারে বলেও জানান তিনি।
গত ডিসেম্বর মাসে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ আবারও নীতি সুদহার কমিয়েছে। তবে ২০২৫ সালে সুদহার কমানোর এই গতি কিছুটা কমতে পারে। নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের কার্যক্রমের কারণেও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়নে বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে। ট্রাম্প নির্বাচনী প্রচারণা সময়ই ঘোষণা দেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তিনি চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা পণ্যে শুল্ক বৃদ্ধি করবেন। সেই সঙ্গে বাণিজ্যের নিয়মকানুন শিথিল করাসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নেবে তারা।
সোনার দাম বাড়ার মূল কারণ হলো, অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক উত্তেজনায় সোনা নিরাপদ বিনিয়োগমাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয়। আর্থিক পরিষেবা কোম্পানি এক্সিনিটি গ্রুপের প্রধান বাজার বিশ্লেষক হান ট্যান বলেন, ট্রাম্পের শাসনামলে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়লে ২০২৫ সালেও সোনার বাজার ঊর্ধ্বমুখী থাকতে পারে।
গোল্ডম্যান স্যাকসের পণ্যবিষয়ক কৌশলবিদ ডান স্ট্রুইভেন বলেন, ভবিষ্যতে সোনার দাম আউন্সপ্রতি তিন হাজার ডলারে উঠতে পারে; কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচ্চ চাহিদা ও ফেডের সুদহার কমানোর কারণে দাম এভাবে বাড়তে পারে।
২০২৪ সালে সোনার দাম রেকর্ড ভেঙেছে অনেকবার। শুধু তৃতীয় প্রান্তিকে মোট চাহিদা অতিক্রম করেছিল ১০ হাজার কোটি ডলার। গত ৩১ অক্টোবর মূল্যবান ধাতুটি আউন্সপ্রতি রেকর্ড ২ হাজার ৭৯০ ডলার ১৫ সেন্টে উঠে যায়; এরপর অবশ্য দাম বেশ কিছুটা কমেছে। গত বছর প্লাটিনাম ও প্যালাডিয়ামের দাম ৭ ও ১৭ শতাংশ কমেছে।
দেশে স্বর্ণের বাজারে অস্থিরতা, ২০২৪ সালে দাম সমন্বয় ৬২ বার
বিদায়ী ২০২৪ সালে বাংলাদেশের বাজারে স্বর্ণের দামে ব্যাপক অস্থিরতা দেখা গেছে। বছরটিতে মোট ৬২ বার স্বর্ণের দামের সমন্বয় করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৫ বার দাম বাড়ানোর পাশাপাশি কমানো হয়েছে ২৭ বার।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস) সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের ১৮ জানুয়ারি ১মবার স্বর্ণের দাম নির্ধারণ করা হয়। সে সময় সবচেয়ে ভালো মানের বা ২২ ক্যারেটের এক ভরি স্বর্ণের দাম নির্ধারণ করা হয় ১ লাখ ১২ হাজার ৪৪১ টাকা।
আর সর্বশেষ দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০ ডিসেম্বর। ওই দিন ২২ ক্যারেটের এক ভরি স্বর্ণের দাম নির্ধারণ করা হয় এক লাখ ৩৮ হাজার ২৮৮ টাকা। অর্থাৎ বছরের শুরুতে এক ভরি স্বর্ণের যে দাম নির্ধারণ করা হয় তার থেকে আরও ২৫ হাজার ৮৪৭ টাকা বেড়ে বছর শেষ হয়।
স্থানীয় বাজারে তেজাবি স্বর্ণের (পাকা স্বর্ণ) দাম কমানোর প্রেক্ষিতে সর্বশেষ ৩০ ডিসেম্বর স্বর্ণের নতুন দাম নির্ধারণ করে বাজুস।
সংগঠনটির স্ট্যান্ডিং কমিটি অন প্রাইসিং অ্যান্ড প্রাইস মনিটরিং কমিটির বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সবেচেয়ে ভালো মানের বা ২২ ক্যারেটের এক ভরি স্বর্ণের দাম এক হাজার ৫০ টাকা কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে এক লাখ ৩৮ হাজার ২৮৮ টাকা।
এ ছাড়া ২১ ক্যারেটের এক ভরি স্বর্ণের দাম ১ হাজার চার টাকা কমিয়ে এক লাখ ৩২ হাজার এক টাকা নির্ধারণ করা হয়। ১৮ ক্যারেটের এক ভরি স্বর্ণের দাম ৮৬৩ টাকা কমিয়ে এক লাখ ১৩ হাজার ১৪১ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
আর সনাতন পদ্ধতির এক ভরি স্বর্ণের দাম ৭৩৫ টাকা কমিয়ে ৯২ হাজার ৮৬৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়। বর্তমানে এই দামে দেশের বাজারে স্বর্ণ বিক্রি হচ্ছে।
বাজুসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ২২ ক্যারেটের এক ভরি স্বর্ণ সর্বোচ্চ এক লাখ ৪৩ হাজার ৫২৬ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ৩১ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত এই দামে স্বর্ণ বিক্রি হয়। আর চলতি বছর ২২ ক্যারেটের এক ভরি স্বর্ণের সর্বনিম্ন দাম ছিল এক লাখ ১০ হাজার ৬৯১ টাকা। ১৯ জানুয়ারি থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত এই দামে স্বর্ণ বিক্রি হয়।
৬ বছরে দেশের বাজারে স্বর্ণের ভরিতে বেড়েছে ৯০ হাজার ৮১৬ টাকা
সর্বশেষ ৩০ ডিসেম্বর (সোমবার) দেশের বাজারে সোনার দাম খানিকটা কমেছে। সবচেয়ে ভালো মানের (২২ ক্যারেট) সোনার দাম ভরিতে ১ হাজার ৫০ টাকা কমেছে। এর আগে সবশেষ গত ২৩ ডিসেম্বর দেশের বাজারে সোনার দাম সমন্বয় করেছিল বাজুস। সে সময় ভরিতে ১২৪৮ টাকা কমিয়ে ২২ ক্যারেটের এক ভরি সোনার দাম ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩৩৮ টাকা নির্ধারণ করেছিল সংগঠনটি।
ফলে ১ জানুয়ারি (বুধবার) থেকে ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি সোনার দাম কমে হয়েছে ১ লাখ ৩৮ হাজার ২৮৮ টাকা। বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাজুস) মূল্য নির্ধারণ ও মূল্য পর্যবেক্ষণ কমিটির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
বাজুসের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিদায়ী ২০২৪ সালে মোট ৬২ বার স্বর্ণের দামের সমন্বয় করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৫ বার দাম বাড়ানোর পাশাপাশি কমানো হয়েছে ২৭ বার। এ বছরের ১৮ জানুয়ারি ১মবার স্বর্ণের দাম নির্ধারণ করা হয়। সে সময় সবচেয়ে ভালো মানের বা ২২ ক্যারেটের এক ভরি স্বর্ণের দাম নির্ধারণ করা হয় ১ লাখ ১২ হাজার ৪৪১ টাকা। ২০২৩ সালে ২৯ বার সোনার দাম সমন্বয় করা হয়। এর মধ্যে দাম কমানো হয় ১১ বার, বাড়ানো হয় ১৮ বার। এ বছরের শুরুতে (জানুয়ারি) ভালো মানের অর্থাৎ হলমার্ক করা ২২ ক্যারেটের এক ভরি সোনার দাম ছিল ৮৮ হাজার ৪১৩ টাকা। ২০২২ সালের শুরুতে ২২ ক্যারেট মানের প্রতি ভরি সোনা বিক্রি হয় ৭৩ হাজার ১৩৩ টাকায়। ২০২১ সালের জানুয়ারির শুরুতে এই মানের প্রতি ভরি সোনার দাম ছিল ৭২ হাজার ৬৬৭ টাকা। এছাড়া ২০২০ সালের জানুয়ারির শুরুতে ছিল ৫৯ হাজার ১৯৫ টাকা এবং ২০১৯ সালের জানুয়ারির শুরুতে দাম ছিল ৪৭ হাজার ৪৭২ টাকা।
হিসাব করে দেখা গেছে, বিগত ৬ বছরে ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি সোনার দাম বেড়েছে ৯০ হাজার ৮১৬ টাকা।
অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুলাই মাসের শেষের দিকে প্রথমবারের মতো সোনার ভরি লাখ টাকা ছাড়ায়। মাঝে অবশ্য একবার লাখের নিচে নেমেছিলো। এর পর থেকে বাড়ছেই। অথচ বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগের বছর অর্থাৎ ১৯৭০ সালে সোনার ভরি ছিল ১৫৪ টাকা। ১৯৭৩ সালে ছিল ৫০০-৬০০ টাকা।
২০০০ সালে সোনার ভরি বেড়ে ৬ হাজার ৯০০ টাকায় দাঁড়ায়। ২০১০ সালে এই ধাতুর দাম বেড়ে ভরি ৪২ হাজার ১৬৫ টাকা হয়। ২০২০ সালে সোনার ভরি ৬৯ হাজার ৮৬৭ টাকায় পৌঁছায়।
বাজুসের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০২ সালে বাংলাদেশে প্রতি ভরি সোনার দাম ছিল ৬ হাজার টাকা। বর্তমানে ১ লাখ ৩৮ হাজার ২৮৮ টাকা। হিসাব বলছে, এই দুই দশকে ২৩ গুণ বেড়েছে এই ধাতুর দাম।
মূলত করোনা মহামারির পর বিশ্বব্যাপী সোনার দামে অস্থিরতা দেখা দেয়। তখন নিরাপদ বিনিয়োগের জন্য সোনাকেই বেছে নেওয়ার প্রবণতা বাড়ে। এতে বিশ্ববাজারে প্রতি আউন্স সোনার দাম ২ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যায়।
করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর সোনার দাম কিছুটা কমলেও ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর আবার বাড়তে থাকে। ২০২৩ সালের শেষ দিকে অবশ্য সোনার দাম কিছুটা কমেছিল।
মূলত টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণেই দেশের বাজারে সোনার দাম লাখ টাকা ছাড়িয়েছে বলে মনে করছেন দেশের স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা।
বিশ্বে সোনাকেই সবচেয়ে স্থিতিশীল ও নির্ভরযোগ্য পণ্য হিসেবে ধরা হয়। বলা হয়, একমাত্র এই পণ্যটির দরেই সাধারণত বড় ধরনের অস্থিতিশীলতা দেখা যায় না। এটি কিনে রাখলে লোকসানের ভয় নেই। এ কারণেই সোনার প্রতি সবার এত আকর্ষণ। ৫০ বছর আগে কেউ সোনা কিনে রাখলেও তা ভালো বিনিয়োগ হিসেবেই বিবেচিত। শেয়ারবাজার, ডলার বা অন্য কিছু- এই নিশ্চয়তা দেয় না।
ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, সাধারণ ভোক্তা পর্যায়ে সোনার কেনাকাটা হয় গহনাসামগ্রীতে। এই শ্রেণির ক্রেতার কাছে গহনার চাহিদা ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে কমেছে ১৫ শতাংশেরও বেশি। কিন্তু এর পরও আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দাম বাড়ছে।
কেন বাড়ছে স্বর্ণের দাম
স্বর্ণের দামের সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতির একটি সম্পর্ক আছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে আগামী দিনগুলোতেও অনিশ্চয়তা এবং ঝুঁকি থাকবে বলে বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন। করোনা মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে। ইসরায়েল–ফিলিস্তিন যুদ্ধ সেই অনিশ্চয়তার পালে কিছুটা হলেও হাওয়া দিয়েছে। যত বেশি অনিশ্চয়তা, তত বেশি সোনা বিক্রি। যত বেশি মূল্যস্ফীতি, তত বেশি সোনার মূল্যবৃদ্ধি। ঐতিহাসিকভাবেও দেখা গেছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়েই সোনার দাম সবচেয়ে বেশি বাড়ে।
এমন নয় যে, সোনার দাম কেবল লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছেই। মাঝেমধ্যে কমছেও। এটাও অনিশ্চয়তার ফল। সুদের হার বাড়ানো নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতা বা অর্থনীতি মন্দায় আক্রান্ত হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তার ওপরও নির্ভর করছে সোনার দামের ওঠানামা।
এই দাম আপাতত কমবে, এমন পূর্বাভাসও কেউ দিচ্ছেন না। যখনই মনে হয় অর্থনীতির সঙ্কট হয়তো কেটে যাচ্ছে, তখনই সোনার দাম খানিকটা পড়ে যায়। আবার যখন মনে হয় সুদহার বাড়িয়েও কাজ হচ্ছে না, তখনই দাম বাড়ে সোনার।
গণমাধ্যমকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, অর্থনীতির গবেষক, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, অর্থনৈতিক সংকট দীর্ঘ হলে এবং এর থেকে মূল্যস্ফীতি বাড়ার ভয় তীব্র হলে সংশ্লিষ্ট দেশের অর্থনীতি স্বাভাবিক রাখতে আর্থিক কর্তৃপক্ষের কাছে অর্থের চেয়ে ক্ষয়হীন সোনার মজুদের প্রতি ঝোঁক বাড়ে। কারণ অর্থের (টাকা বা ডলার) মান যেকোনো সময় অবনমন হতে পারে, কিন্তু সেই অর্থে মজুত সোনার কোনো ক্ষয় হয় না।
দীর্ঘদিন আইএমএফের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করা এই অর্থনীতিবিদ বলেন, সংকটকালে সোনার মজুত বাড়াতে পারলে সংশ্লিষ্ট দেশ অর্থনৈতিকভাবেও অন্যের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে। কেননা, পরে দাম বেশি পেলে ওই সোনা বিক্রি করেও আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যায়। তবে কোনও কোনও কেন্দ্রীয় ব্যাংক কী পরিমাণ সোনা কিনছে বা বিক্রি করছে তা খুব একটা বাইরে প্রকাশ পায় না।
আহসান মনসুর বলেন, স্বর্ণ কিনে কারো লোকসান হয়েছে বা কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, এমন নজির বিশ্বে নেই। একই কথা সাধারণ ভোক্তার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এ কারণে করোনা মহামারি ও যুদ্ধের কারণে মানুষের আয় ও স্বাভাবিক বিনিয়োগ কমে গেলেও সামর্থ্যবানরা সোনা বা স্বর্ণালঙ্কার মজুতে বিনিয়োগ করছেন।
শুধু বাংলাদেশে নয়, প্রায় সব দেশে বহুকাল ধরেই মানুষ নিরাপদ ভেবে স্বর্ণে বিনিয়োগ করছেন, বলেন এই অর্থনীতিবিদ।
সোনার দাম ও ভোক্তার আচরণ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দুজন অর্থনীতিবিদ গবেষণা করেছেন। গোল্ডেন ডিলেমা’ নামে ওই গবেষণায়ও দাবি করা হয়, ‘সঙ্কটকালে সোনার দাম বাড়ে। ভয় বা আতঙ্কের কারণেই এটা হয়, যা ১৯৩০ সালের মহামন্দার পর থেকে দৃশ্যমান হতে দেখা গেছে।
সোনার কেনাকাটায় স্থানীয় বাজারে নিয়ন্ত্রণ খুব একটা না থাকলেও আন্তর্জাতিক বাজারে যাতে কোনো ‘বাবল’ তৈরি হতে না পারে সেজন্য সিলিং বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে ১৯৯৯ সালে ওয়াশিংটন চুক্তি নামে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তিও রয়েছে। এই চুক্তি অনুযায়ী, কোনও কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক বছরে ৪০০ টনের বেশি সোনা বিক্রি করতে পারবে না।
স্বর্ণের দাম বাড়াচ্ছে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি
তিন বছর আগে বাংলাদেশে ১ ডলারের জন্য গুনতে হতো ৮৫ টাকা। এখন লাগে ১২০ টাকা। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বব্যাপীই ডলারের রমরমা অবস্থা। বিশ্বের বেশিরভাগ প্রধান মুদ্রা ডলারের বিপরীতে মূল্যমান হারিয়েছে। ফলে চাঙা ডলার অনেক দেশের জন্যই বিপদের কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
বিশেষ করে স্বল্প আয়ের দেশগুলো আছে বেশি বিপদে। তাদের আমদানি বেশি, রপ্তানি কম। আর সিংহভাগ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য যেহেতু ডলারে করতে হয়, তাই এসব দেশকে টিকে থাকতে মুদ্রার অবমূল্যায়ন করতে হচ্ছে।
ডলারের ওপর অতিনির্ভরশীলতা থেকে বাঁচতে রাশিয়া ও চীনসহ বিভিন্ন দেশ বহু আগে থেকেই সোচ্চার। ভবিষ্যতেও হয়তো এ নিয়ে নানা উদ্যোগ থাকবে। এতে ডলারের ওপরে আস্থা কমে গেলে অনেকেই সোনার দিকে ঝুঁকে পড়বে।
জ্বালানি তেলের কেনাবেচার সঙ্গেও সোনার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। সাধারণত দেখা গেছে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে সোনার দামও বেড়ে যায়। কারণ, তখন অনেক দেশই সোনার বিনিময়ে জ্বালানি তেল বিক্রি করে থাকে। আর যেহেতু এখন ডলারের কারণে বিশ্বের মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা চলছে, ফলে বিনিময় মাধ্যম হিসেবে সোনার চাহিদাও বাড়ছে।
বাংলাদেশে স্বর্ণের চাহিদা কত
বাংলাদেশের সোনার চাহিদা কত, এ নিয়ে নির্ভরযোগ্য কোনও তথ্য নেই। স্বর্ণ নীতিমালায় বলা আছে, দেশে প্রতিবছর ২০ থেকে ৪০ মেট্রিক টন সোনার চাহিদা তৈরি হচ্ছে। আবার বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি বলছে, প্রতিবছর সোনা চোরাচালানের আর্থিক পরিমাণ ৭৩ হাজার কোটি টাকা। মূলত সোনা চোরাচালানের অর্থ হুন্ডিতে লেনদেন হয়।
আবার গহনা বানানো ছাড়া দেশে সোনার তেমন কোনো চাহিদাও নেই। অন্যান্য দেশের মতো সোনায় বিনিয়োগ করার মতো কোনো বন্ড বা আর্থিক উপাদানও গড়ে ওঠেনি। ফলে গহনা বানানো বা সোনার বার কিনে রাখাই এখন একমাত্র বিনিয়োগ। অথচ সোনায় বিনিময়যোগ্য আর্থিক কোনো উপাদান থাকলে তাতে দেশই লাভবান হতে পারত, যা পাশের দেশ ভারতেও রয়েছে।
বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বাজুসের সভাপতি সায়েম সোবহান আনভীর বলেন, এখন ভরি এক লাখ টাকার কিছু বেশি; ২০ বছর পর ১০ লাখও হতে পারে এটা। এভাবে চিন্তা করতে হবে। শুধু দাম বাড়লো সেটা নিয়ে হতাশ হলে চলবে না। যারা আগে কিনেছেন, তারা কত লাভবান হয়েছেন, সেটা তো চিন্তা করতে হবে। স্বর্ণের দাম আমরা নির্ধারণ করি না, আন্তর্জাতিক বাজারে নির্ধারণ হয়। সেটার আঙ্গিকে দেশে স্বর্ণের দাম নির্ধারণ করা হয় বলেও জানান তিনি।
বাজুসের তথ্য বলছে, মাত্র ৫ বছরের ব্যবধানেই দেশের বাজারে সোনার দাম বেড়েছে ৯০ হাজার ৮১৬ টাকা। ২০১৯ সালে বাংলাদেশে সবচেয়ে ভালো মানের সোনার ভরি ছিল ৪৭ হাজার ৪৭২ টাকা। এখন ২০২৫ সালে বিক্রি হচ্ছে ১ লাখ ৩৮ হাজার ২৮৮ টাকা।
বিডি/এন