আলুর দাম বাড়তি কেন
Published : ০০:২৩, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
প্রায় তিনমাস ধরে বাজারে আলুর দাম চড়া। রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে পুরাতন আলু ৬৫ থেকে ৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে যা গতমাসে ৭৫ টাকা করে কিনতে হয়েছে। আর নতুন আলু ৭০ থেকে ৭৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে যা গত মাসে ১০০ থেকে ১১০ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে।
এদিকে আলুর ভরা মৌসুম ও ভারত থেকে আলু আসায় বাজারে এর কিছুটা প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ফলে আলুর দাম কিছুটা কমেছে। যদিও সরেজমিনে দেখা গেছে আলুর দাম কেজিপ্রতি ৫ থেকে ১০ টাকা করে কমেছে। তবু স্বস্তি মিলছে না ভোক্তার মনে।
বিক্রেতারা জানান, অধিক দামে আলু কিনে এনে কম দামে বিক্রি করতে পারবেন না। পাইকারি বাজারে দাম বাড়লে, খুচরা বাজারেও বাড়বে। কিন্তু পাইকারি বাজারে কেন দাম বেশি, এ বিষয়ে জানেন না খুচরাবিক্রেতারা।
শুক্রবার (২০ ডিসেম্বর) রাজধানীর মগবাজার ও রামপুরা কাঁচাবাজারে সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুরাতন আলু বিক্রি হচ্ছে ৬৫ টাকায়। পাইকাররা জানালেন, বেশ কিছুদিন ধরে আলু বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে।
মগবাজারের পাইকারি আলু বিক্রেতা মনির মিয়া জানান, বিক্রমপুরের আলুর দাম বৃদ্ধির ফলে আমাদের এখানেও আলুর দাম বেড়েছে। তারা কেজিপ্রতি খুব কম লাভ করেন। বাজারে সবজির দাম বাড়ার সঙ্গে বেড়েছে আলুর দামও।
পাশে থাকা আরেক আলু বিক্রেতা জানান, বেশি দামে আলু কিনে কম দামে বিক্রি করতে পারবেন না। পাইকারি বাজারে দাম বাড়লে, তারাও বাড়ান। তবে পাইকারি বাজারে দাম বাড়ার বিষয়ে জানেন না তারা।
দাম বৃদ্ধির বিষয়ে রামপুরা কাঁচাবাজারের আলু বিক্রেতা লিয়াকত আলী জানান, কৃষকেরা কম দামে সার পায় না, সরবরাহ কম থাকায় দাম বাড়ছে। এছাড়া সবজির দাম বাড়তি থাকায় আলুর দাম বাড়তি।
এসময় লিয়াকত আলীর কথার সঙ্গে একমত পোষণ করে আলু কিনতে আসা এক ক্রেতা জানান, আলু আবাদের ভরা মৌসুমেও সারের তীব্র সংকট চলছে। এটা কী আলুর দামে প্রভাব ফেলবে না বলেও মত প্রকাশ করেন তিনি।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহীতে আলু আবাদের ভরা মৌসুমেও সারের সংকট দেখা দিয়েছে। চাষিরা সারের অভাবে জমি তৈরির পরও বীজ রোপণ করতে পারছেন না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সারের বরাদ্দ থাকলেও সরবরাহ কম। এছাড়া পরিবহন ঠিকাদার ও ডিলার সিন্ডিকেটের কারণেও সারের সংকট। বিভিন্ন হাতঘুরে সার চলে যাচ্ছে খুচরা ব্যবসায়ীদের দোকানে। এসব সারই কৃষকদের কিনতে হচ্ছে সরকারি দামের চেয়ে বেশি দামে।
কৃষকদের অভিযোগ, জেলা ও উপজেলায় সার মনিটরিং কমিটি থাকলেও ডিলারদের সঙ্গে কৃষি অফিসের মাঠকর্মীদের জোগসাজশ থাকায় অসাধু ডিলারদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। বিভিন্ন উপজেলায় কৃষকরা সারের জন্য হাহাকার করছেন। কোথাও কোথাও সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বস্তায় ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা বেশি দিয়ে সার কিনতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষক।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক উম্মে ছালমা বলেন, চলতি ডিসেম্বর মাসে রাজশাহীতে ডিএপি সারের চাহিদা ছিল ১৭ হাজার ১২৭ মেট্রিক টন। বরাদ্দ এসেছে আট হাজার ১২৪ মেট্রিক টন। এমওপির (মিউরেট অব পটাশ) চাহিদা ছিল ১৮ হাজার ৩৭২ মেট্রিক টন। বরাদ্দ পাওয়া গেছে চার হাজার ২৭৮ মেট্রিক টন এবং ট্রিপল সুপার ফসফেট-টিএসপির চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ২১৬ মেট্রিক টন। বরাদ্দ এসেছে দুই হাজার ৭৩৭ মেট্রিক টন সার। ডিসেম্বরের জন্য বরাদ্দ পাওয়া সার জেলার ২১৮ জন ডিলারের মাঝে সরবরাহ করা হচ্ছে। গত বুধবার পর্যন্ত সরবরাহ এসেছে তিন হাজার ২৫৪ মেট্রিক টন ডিএপি, দুই হাজার ৩৬৪ মেট্রিক টন এমওপি ও দুই হাজার ৫৩৫ মেট্রিক টন টিএসপি। গুদামে মজুত না থাকায় বরাদ্দ করা সার ডিলারদের মাঝে সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না।
আলুর দাম বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে গণমাধ্যমকে গত ২২ নভেম্বর কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এসএম নাজির হোসেন জানান, আলুর দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধির পেছনে বাজার ব্যবস্থাপনা ত্রুটি কাজ করছে। কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যায়ে ৭ থেকে ৮টি স্তর থাকার কারণে ধাপে ধাপে আলুর দাম বৃদ্ধি পায়। আলু সংরক্ষণে কোল্ডস্টোরেজের একচ্ছত্র আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণের কারণে দাম বৃদ্ধি পায় বলেও জানান তিনি।
ক্যাবের অনুসন্ধান তুলে ধরে নাজির হোসেন বলেন, কোল্ডস্টোরেজের মালিকরা উৎপাদন পর্যায়ে তাদের নিজস্ব ব্যাপারীদের মাধ্যমে কৃষক পর্যায়ে দাদন দিয়ে থাকে। দাদন বণ্টন ও নিয়ন্ত্রণের কাজটি করে থাকে আলু উৎপাদন এলাকার এজেন্ট। ক্ষেত থেকে আলু ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এজেন্টরা পূর্ব নির্ধারিত দামে মাঠ থেকে সংগ্রহ করে ব্যাপারীদের মাধ্যমে কোল্ডস্টোরেজে নেয়। যত দিন কৃষকের কাছে আলু থাকে ততদিন আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণে থাকে। আর তারপরই আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় কোল্ডস্টোরেজ-ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট।
এখন যে আলু কারওয়ান বাজারে আসছে- তা ট্রাক থেকে নামার পর দুইটি স্তর পেরিয়ে খুঁচরা পর্যায়ে ক্রেতাদের কাছে যায়। মূলত রাজধানীর বিভিন্ন পাইকারি বাজারগুলো কারওয়ানবাজারসহ দুটি বাজার থেকেই নিয়ন্ত্রণ হয়। যা থাকে কোল্ডস্টোরেজের নিয়ন্ত্রণে; তিনি যোগ করেন।
এদিকে আলুর দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় টিসিবির খোলা ট্রাকে চাল, ডাল, ভোজ্যতেল ও পেঁয়াজের পাশাপাশি ৩০ টাকা দরে আলু বিক্রি শুরু করেছে সরকার। রাজধানীর ৫০টি স্পটে টিসিবির ট্রাকে আলু বিক্রি হচ্ছে। যা ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে।
গত ২০ নভেম্বর রাজধানীর কারওয়ানবাজারে টিসিবির খোলা ট্রাকে আলু বিক্রি কার্যক্রম উদ্বোধন করেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বসির উদ্দিন। এসময় তিনি আলুর বাড়তি দামের মূলে সিন্ডিকেট রয়েছে স্বীকার করে বলেন, সরবারহ ও পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা জোরদারের মাধ্যমে আমরা সিন্ডিকেট অকার্যকর করবো।
রাজশাহী ও বগুড়ার কৃষকরা জানান, তারা আলু কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন। কোথাও কোথাও আগাম দাদন বা টাকা নিয়ে কৃষক আলু চাষ করেন। আলু মাঠে থেকে ওঠানোর সাথে সাথে আগে টাকা নেওয়ায় মহাজনের কাছে বিক্রি করে দিতে হয়। বাজারে আলুর বাড়তি দাম থাকলেও কৃষক তা দাবি করতে পারেন না। পূর্বনির্ধারিত দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন তারা।
অন্যদিকে আলুর দাম প্রতিবছরই নভেম্বর মাসের দিকে সর্বোচ্চ বৃদ্ধি পায়। অজুহাত তোলা হয় আলুর মজুদ কমে আসা। এ সময় আলু আমদানিও করা হয়, এবারও করা হচ্ছে। অথচ দেশে চাহিদার তুলনায় কমপক্ষে ২০ লাখ বেশি আলুর উৎপাদন হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে দেশে আলু বার্ষিক চাহিদা সর্বোচ্চ ৮০ লাখ টন। অথচ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আলুর উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি টনের বেশি। ৩০ লাখ টনের অধিক আলু বেশি উৎপাদন হয়েছে। তারপরও আলু ঘাটতির অজুহাত তুলে দাম বাড়ানো হয়। মূলত বাজার কাঠামো ত্রুটিযুক্ত হওয়া কারণে চাহিদার বেশি আলু উৎপাদন হলেও কৃত্রিম সংকট তৈরি করে আলুর দাম বাড়ানো হচ্ছে।
বিডি/এন