পাহাড়ের সম্ভাবনাময় শিল্প ‘ফুলঝাড়ু’

পাহাড়ের সম্ভাবনাময় শিল্প ‘ফুলঝাড়ু’

আবু রাসেল সুমন

Published : ১৬:৫১, ৯ জুলাই ২০২৪

খাগড়াছড়ির উঁচু-নিচু পাহাড়ের বিস্তৃত এলাকাজুড়ে যেদিকেই চোখ যায়, দেখা মেলে ঝাড়ুফুল, যার জাতীয় নাম "উলুফুল"।

পাহাড়ের ঢালুতে এ ফুলের বিস্তার হয়ে থাকে। প্রাকৃতিকভাবে পাহাড়ের ঢালুতে গজানো এ ফুল স্থানীয়দের কাছে ঝাড়ুফুল বা "ফুলঝাড়ু" নামেই বেশ পরিচিত।

একটি চারা থেকে একটি মাত্র ফুল দেয়ার পর গাছটি মারা যায়। কিন্তু বৃষ্টি হওয়ার পরপরই মূল থেকে নতুন গাছের জন্ম হয়। চাষ বা কোনো পরিচর্যা ছাড়াই পাহাড়ের বুকে প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে উঠা ফুলঝাড়ু সারাদেশেই বেশ পরিচিত লাভ করেছে।

খাগড়াছড়ির বিভিন্ন উপজেলার দুর্গম পাহাড়জুড়ে এ ফুল বেশি দেখা যায়। প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেয়া এ ঝাড়ুফুল দেখতে অনেকটা কাশফুলের ডাঁটার মতো। শীত শুরু হওয়ার পরপরই এসব গাছে ফুল আসে। ডিসেম্বরের মধ্যেই "ঝাড়ুফুল" পরিপূর্ণতা পায়। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত সংগ্রহ করা হয় ফুল।

ইতোমধ্যে পাহাড় থেকে ঝাড়ু তৈরির জন্য ‘ঝাড়ুফুল’ কাটা শুরু হয়েছে। গহীন পাহাড় থেকে এ ফুল সংগ্রহ করা শুরু করেছে সংগ্রহকারীরা। পাহাড় থেকে ‘ফুলঝাড়ু’ কেটে বিক্রির জন্য বাজারে নিয়ে আসেন স্থানীয় লোকজন। ফুলঝাড়ুর ২০-২৫টি কাঠি নিয়ে একটি আঁটি বাঁধা হয়।

বন বিভাগের ভাষায় এটির নাম ‘ভ্রুম’। স্থানীয় চাকমা ভাষায় এ ফুলের নাম চড়ন্দরা, ত্রিপুরা ভাষায় চন্দ্রা, আর মারমা ভাষায় ইনহেজা বলা হলেও সারাদেশে ফুলঝাড়ু বা ঝাড়ুফুল নামেই পরিচিত।

খাগড়াছড়ির বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, সড়কের পার্শ্বে "ঝাড়ুফুল" আঁটি বেঁধে সারি সারি করে সাজিয়ে ক্রেতার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন বিক্রেতারা। অনেকে আবার স্থানীয়দের কাছ থেকে কম দামে কিনে পাইকারদের থেকে বেশি লাভে বিক্রির আশায় "ফুলঝাড়ু" নিয়ে অপেক্ষা করছেন।

২০ /২৫টি কাঠি দিয়ে একটি ঝাড়ুর আঁটি বাঁধা হয়। আঁটির আকার ও মানভেদ নির্ণয় করে ২০/৩০ টাকা বিক্রি হয়। হাত বদলে ঝাড়ুফুলের এই আঁটি ৮০-১০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। এক বান্ডিলে ৫০/১০০ টি আঁটি থাকে। প্রতিটি বান্ডিল ৯০০-২৫০০ টাকায় বিক্রি করা হয়।

বান্ডিল ও প্রকারভেদে এর মূল্য নির্ধারণ হয়ে থাকে। এরপর বাজার থেকে স্থানীয়রা ব্যবহারের জন্য সেগুলো কিনে নেয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও দেশের বড় বড় শহর থেকে আগত পাইকারি ব্যবসায়ীরা স্থানীয় বাজারগুলো থেকে ফুলঝাড়ু কিনে নিয়ে দেশের বিভিন্ন বাজারে সরবারহ করেন।

এ "ফুলঝাড়ু" এলাকার মানুষের আয়ের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাগড়াছড়ি, পানছড়ি, দীঘিনালা, মহালছড়ি, মাটিরাঙ্গা, গুইমারা, রামগড়, মানিকছড়ি ও লক্ষীছড়িসহ বিভিন্ন উপজেলায় রয়েছে ফুলঝাড়ুর আড়ত ও মাঠ। স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা এসব আড়ত ও মাঠে স্তূপ করে রাখা হয়েছে ফুলঝাড়ু।

প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত পাহাড়ের এই ফুলঝাড়ু ঘরবাড়ি থেকে শুরু করে দোকান পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে প্রতিদিনই ব্যবহৃত হচ্ছে। ব্যাপক চাহিদা থাকায় প্রতিবছর ঝাড়ুফুল দেশের গন্ডি পেরিয়ে মধ্যেপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে।

প্রাকৃতিক এ ঝাড়ুফুল বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছে পাহাড়ে বসবাসরত বহু পরিবার। এটি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করা গেলে পাহাড়ের মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতো। পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন অনেকেই।

স্থানীয় ঝাড়ুফুল সংগ্রহকারী হারাধন ত্রিপুরা বলেন, প্রতিবছর জেলার বিভিন্ন দুর্গম এলাকার উঁচু-নিচু পাহাড়ের ঢালু থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কেটে আনতে দ্বিগুণ মূল্য পরিশোধ করতে হয় শ্রমিকদের।

এই কাঁচা ফুলগুলো এনে আঁটি বেঁধে স্তূপ করে রাখা ও সাপ্তাহিক হাট বারের দিনে সকালে ট্রাকে করে বাজারে নিয়ে আসা হয়। প্রতিবছর ৩০-৪০ হাজার বান্ডিল "ঝাড়ুফুল" সংগ্রহ করি। সে অনুযায়ী ন্যায্যমূল্য পাওয়া যায় না।

স্থানীয় ফুলঝাড়ু আড়ৎদার মো. আবদুল করিম বলেন, পাহাড়ে রাস্তার ধারে কয়েক বছর আগেও এ ফুল পাওয়া যেত। নির্বিচারে পাহাড়ি বনজ সম্পদ ও বন নিধনের ফলে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো ও সম্ভাবনাময় "ফুলঝাড়ু" দিনদিন কমে যাচ্ছে। দুর্গম এ উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে ফুলঝাড়ু কেটে আনতে হয়। ফলে দামও একটু বেশি।

চট্রগ্রামের ঝাড়ুফুলের পাইকারি ব্যবসায়ী সরাফত উল্ল্যাহ জানান, ২৭ বছর ধরে পাহাড়ে বসবাসরত নিম্নআয়ের মানুষের কাছ থেকে কাঁচা আঁটি ১০-১৫ টাকা পাইকারি দরে ঝাড়ুফুল কিনে নেই। তারপর রোদে শুকিয়ে শ্রমিক দিয়ে নতুনভাবে ঝাড়ুর মোচা বানিয়ে ট্রাকে করে ঢাকা-কুমিল্লায় নিয়ে ৪০-৬০ টাকায় বিক্রি করি।

১৯৯৬ সালে তিনি প্রথম ঝাড়ু ব্যবসা শুরু করেন বলে জানান। বর্তমানে ৩ শতাধিক শ্রমিক তার অধীনে ঝাড়ুফুল রোদে শুকানো ও ঝাড়ুর আঁটি বাঁধার কাজে নিয়োজিত রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, আমি মনে করি, সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া গেলে আত্মকর্মস্থান ও পাহাড়ের মানুষের আর্থিক সংকট নিরসনে ভূমিকা রাখতে পারবে এই শিল্প।

তবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এই ফুলঝাড়ু সরবরাহ করতে সড়কের বিভিন্ন স্থানে চাঁদা দিতে হয় বলে অভিযোগ করেছেন অনেক ব্যবসায়ী। টাকা দিতে অনীহা প্রকাশ করলে গাড়ীসহ মাল আটক ও গাড়িতে অবৈধ জিনিস আছে বলে হেনস্তার স্বীকার হতে হয় এমনটাও জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হলে পাহাড়ের নিম্নআয়ের মানুষ অর্থনৈতিকভাবে যেমন সচ্ছল হবে তেমনি নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে।

প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেয়া এই ফুল দৈনন্দিন ঘর পরিস্কার-পরিছন্ন রাখার কাজে যেমন ব্যবহৃত হচ্ছে, তেমনি দেশের অর্থনীতিতেও অবদান রাখছে এই ফুলঝাড়ু। যা থেকে রাজস্ব জমা হয় সরকারের তহবিলে।

বিডি/এন

শেয়ার করুনঃ
Advertisement