আড়িয়াল বিলের শাপলায় খুলছে ভাগ্যের চাকা
Published : ১১:৩৯, ১০ জুলাই ২০২৪
আষাঢ়ের শেষ সময় বর্ষার থৈ-থৈ পানিতে নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যে আবির্ভূত হয়ে উঠেছে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার আড়িয়াল বিল। সেই সৌন্দর্য্যকে অপার রূপে মেলে ধরেছে বিস্তীর্ণ বিলে জন্মানো শাপলা।
শুস্ক মৌসুমে এ বিলে ধান, বিশাল মিষ্টি কুমড়া ও নানা প্রকারের সবজি আবাদ আর ডাঙ্গার মাছ শিকারে ব্যস্ত সময় কাটিয়ে থাকেন স্থানীয়রা। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে পুরো বিল পানির নীচে থাকায় তেমন কোনো কাজই থাকে না তাদের হাতে।
বেকার হয়ে পড়েন নিন্ম আয়ের পরিবারগুলো। তবে বিলে জন্মানো শাপলাই হয়ে উঠে কর্মহীনদের জীবন-জীবিকার আশার আলো। বর্ষায় আড়িয়াল বিলের শাপলায় খুলেছে সেই সব কর্মহীনদের ভাগ্যের চাকা।
শাপলা কুড়িয়ে বিক্রি করে রোজগারের পথ খুঁজে পেয়েছেন বিলের অসংখ্য পরিবার। দিনের কয়েক ঘন্টায় কুড়ানো শাপলা বিক্রি করেই সংসার চালাচ্ছেন প্রায় ৫ শতাধিক পরিবার।
শাপলা কুড়িয়ে বিক্রি করে একেকজনের দৈনিক রোজাগার হয়ে থাকে ৫০০ টাকা থেকে হাজার টাকা। কর্মহীন মানুষদের কাছে বিলের এ শাপলা আল্লাহর নেয়ামত অথবা আর্শিবাদ স্বরূপ।
তাদের কুড়ানো এ শাপলা স্থানীয় বাজারে বিক্রির পাশাপশি যাচ্ছে রাজধানী ঢাকায়। অনেক পাইকার বিল থেকে শাপলা কিনে ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছেন। আবার অনেকে নিজেরাই পিকআপ ভ্যান ও ট্রাকে করে শাপলা বিক্রি করতে নিয়ে যান ঢাকার বিভিন্ন বাজারে।
এদিকে আড়িয়াল বিলের দিগন্তেজুড়ে থাকা শাপলায় যে কারো মন ভালো হয়ে যাবে। মনোমুগ্ধকর সেই মনে কেড়ে নেয় সবার। আর সেই শাপলা কুড়াতে প্রতিদিন ভোরে সূর্য উঠার আগেই বিলে নেমে পড়েন কর্মহীন কিশোর-তরুণ থেকে শুরু করে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা।
ছোট ছোট ডিঙ্গী ও কোষা নৌকায় করে বিলের পানে তাদের ছুটে চলার দৃশ্য চোখে পড়ে। একেকটি ডিঙ্গী ও কোষা নৌকায় ৩-৪ জন থাকেন। এরপর তারা আড়িয়াল বিলের গাদিঘাট, আলমপুর, লস্করপুর, মদনখালী ও শ্রীধরপুর গ্রামের বিলে প্রকৃতির দান শাপলা কুড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
দুপুরেই কুড়ানোর পালা শেষে ডিঙ্গী ও কোষা নৌকায় শাপলাভর্তি করে ফেরেন বিলের পাড়ে। বিকেলে বিলের বিভিন্ন গ্রামের রাস্তার পাশে স্তুপ করেন। সেখান থেকে পাইকাররা শাপলা কিনে নেন। ট্রাক ও পিকআপ ভ্যানে করে সেই শাপলা ঢাকার বিভিন্ন বাজারে নিয়ে যান পাইকাররা।
অন্যদিকে সবজি হিসেবে খাবারের তালিকায় শাপলার জুড়ি নেই। বর্ষা মৌসুমে শুধুমাত্র শাপলা পাওয়া যায়। এতে এ মৌসুমে অনেকের কাছেই প্রিয় সবজি হয়ে উঠে এ শাপলা। আড়িয়াল বিলের শাপলারও কদর বাড়ে।
উপজেলার গাদিঘাট গ্রামের বাসিন্দা মো. নুরুজ্জমান (৪৫)। তিনি কৃষি কাজ করেন। বর্ষায় হাতে কোনো কাজ নেই। তাই বিস্তীর্ণ বিলে শাপলা কুড়িয়ে সংসারের খরচ মেটাচ্ছেন তিনি।
নুরুজ্জামান জানান, সকালে ডিঙ্গী নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়েন বিলে। আধাবেলা শাপলা কুড়াতে বিল জুড়ে ঘুরে বেড়ান। প্রতিদিন তিনি ৪০ থেকে ৫০ আটি শাপলা কুড়িয়ে থাকেন। একেক আটিতে ২০ টি করে শাপলা থাকে। পাইকারদের কাছে ১৪ টাকা করে শাপলা বিক্রি করেন।
তিনি বলেন, যেদিন বেশি শাপলা তুলতে পারি, সেদিন টাকা বেশি কামাই। কোনো দিন শাপলা বিক্রি করে ৫০০ টাকা, আবার কোনো দিন ৭০০ টাকা রোজগার করি।
একই গ্রামের দিনমজুর মো. মিরাজ (৫০)। বর্ষায় কোনো কাজ না থাকায় তার উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন এখন শাপলা কুড়ানো। ভোরে শাপলা কুড়াতে বিলে ছুটে যান। শাপলা কুড়িয়ে নৌকাভর্তি করে দুপুর ২ টার দিকে ফিরেন। এরপর গ্রামের রাস্তার পাশে স্তুপ করেন শাপলা। বিকেলে পাইকার আসেন। সেসময় পাইকারের কাছে শাপলা বিক্রি করে বাড়ি ফিরেন।
মিরাজ বলেন, শাপলা কুড়িয়ে সংসার চলার পাশাপাশি কিছু আয় হয়। প্রতিদিন ৭০০ থেকে হাজার টাকা রোজগার হয়ে থাকে।
স্থানীয় আলমগীর হোসেন জানান, অনেকে একটি ডিঙ্গী বা নৌকায় ৩-৪ মিলে শাপলা কুড়াতে বের হয়ে থাকে। তারা বেশি পরিমাণে শাপলা কুড়াতে পারে। এতে তাদের রোজগার বেশি হয়ে থাকে। আড়িয়াল বিলের বিভিন্ন গ্রামের ৫ শতাধিক পরিবার শাপলা কুড়িয়ে জীবন-জীবিকা নির্বাহের সঙ্গে জড়িত আছে।
উপজেলার আলমপুর গ্রামের পাইকার মো. আয়নাল হক স্থানীয়দের কাছ থেকে শাপলা কিনে ঢাকার বিভিন্ন বাজারে সরবরাহ করে থাকেন।
তিনি জানান, বর্ষার শুরুতে বর্তমানে বিলে পানি কম। তাই এখন শাপলার পরিমাণ কম। তবে পানি বাড়লে শাপলাও বাড়বে বিলে। একেক আটি শাপলা ১৪-১৬ টাকায় কিনে থাকেন পাইকাররা।
বিডি/ও