মানবিক তাড়নায় ঝুঁকি নিয়ে ছুটে যান স্বেচ্ছাসেবকরা
Published : ১৫:৪১, ২৯ আগস্ট ২০২৪
দুর্যোগে বা দুর্ঘটনায় বিপদগ্রস্ত মানুষকে উদ্ধারের জন্য সবার আগে ছুটে আসেন এক দল মানুষ। তাদের বলা হয় স্বেচ্ছাসেবক।
স্বেচ্ছাসেবকরা নিজেকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়ে বিপন্ন মানুষকে উদ্ধার করেন, যাদের সঙ্গে হয়তো তার পারিবারিক বা রক্তের সম্পর্কও নেই। প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট যেকোন দুর্যোগে প্রথম সারিতে থাকেন তারা। বিপন্ন মানুষকে উদ্ধারের পর তাদের মানবিক দায়িত্ববোধ যেন আরও বহুগুণ বেড়ে যায়।
সম্প্রতি স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার মুখোমুখি হয়েছে দেশের কমপক্ষে ১২টি জেলা। এর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ৩ জেলার মধ্যে একটি হচ্ছে ফেনী। বরাবরের মতো এবারেও পানিবন্দি মানুষ উদ্ধারে ছুটে যান স্বেচ্ছাসেবকরা।
টানা বৃষ্টি ও ভারত থেকে আসা বানের পানিতে গত ২০ আগস্ট সেখানে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেয়। অল্প সময়ের ব্যবধানে কয়েক'শ গ্রাম সম্পূর্ণ তলিয়ে যায়। কোথাও কোথাও তলিয়ে যায় দোতলা স্কুল ভবনও।
সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর উদ্ধার অভিযান প্রক্রিয়া তখনও কাগজ-কলমে আবদ্ধ। বিরামহীন ভারী বৃষ্টি ও পানির তীব্র স্রোত এসব প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে বিপন্ন মানুষ উদ্ধারে নৌকা নিয়ে প্রত্যন্ত গ্রামগুলোর দিকে যাত্রা করে স্বেচ্ছাসেবকরা।
ঘুটঘুটে অন্ধকার, বিষধর সাপের ভয়, সব ধরনের নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্নতাকে তোয়াক্কা না করে তারা বিবেকের তাড়নায় ছুটে যান গভীর পানিতে ডুবন্ত গ্রামীণ সড়ক ধরে।
ফেনী সদরের শর্শদী ও এর আশপাশের কয়েকটি গ্রামের আনুমানিক ৩০ জন স্বেচ্ছাসেবক কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে চরম বৈরী পরিস্থিতিতে কাজ শুরু করেন। তাদের অধিকাংশই শিক্ষার্থী। এলাকাবাসীর সহায়তায় তারা কয়েকদিনে উদ্ধার করেন নারী-শিশু-বৃদ্ধসহ কমপক্ষে দুই হাজার বিপন্ন মানুষকে।
স্বেচ্ছাসেবকদের এই সাহসিকতায় মুগ্ধ হয়েছেন সবাই। উদ্ধার হওয়ার পর অনেকে তাদের বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছেন, 'তোমরা যদি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের উদ্ধার না করতা, তা হলে আমরা বেঁচে থাকতাম কী না জানি না।'
উদ্ধার কাজের ভয়াবহতা বর্ণনা করতে গিয়ে এক স্বেচ্ছাসেবক বলেন, 'আমরা মাছের খামারে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের তৈরি অনেকগুলো বোট সংগ্রহ করি। এগুলো নিয়েই আমরা ভারী বৃষ্টির মধ্যে নেমে পড়ি সম্পূর্ণ তলিয়ে যাওয়া গ্রাম বান্ধেরজলা, আবুপুর, হিন্দুগ্রামে পানিবন্দি মানুষ উদ্ধার করতে। তখনও আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করেনি কোন কর্তৃপক্ষ।
টানা ৭২ ঘণ্টা উদ্ধারকাজ চালিয়ে প্রায় দুই হাজারের বেশি মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসি। এই এলাকায় শর্শদী হাইস্কুল, শর্শদী গার্লস স্কুল, শর্শদী মাদরাসার পাকা ভবনসহ ১৩টি অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র চালু রয়েছে। তাদের জন্যে রান্না করা খাবার দেয়া হচ্ছে দিনে তিন বেলা। গৃহপালিত পশুদের জন্যেও রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা।'
তিনি আরও বলেন, 'পানিতে ভিজতে ভিজতে আমাদের পা ফুলে গেছে। কারও কারও হাতে-পায়ে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। তবুও আমরা দিন-রাত কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।'
বিবেকের তাড়নায় মানবতার সেবার ঝাঁপিয়ে পড়া এমন স্বেচ্ছাসেবকদের অনেকেরই পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো না। অধিকাংশ শিক্ষার্থী হওয়ায় তাদের অনেকের অর্থ কষ্টও রয়েছে। তাদের মধ্যে যারা সচ্ছল তারা অন্য বন্ধুদের পকেট খরচ দিয়ে দিচ্ছে।
তারা বন্যার্তদের ত্রাণ সহায়তা সংগ্রহের কাজ করে গেলেও সেই অর্থ নিজেদের চা-পানির খরচ চালাতে ব্যবহার করতে তাদের বিবেকে বাধা দেয়।
এক প্রশ্নের উত্তরে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্বেচ্ছাসেবক বলেন,' আমরা তো এই মানবিক কাজের জন্য পারিশ্রমিক চাইতে পারি না। আমাদের বিবেকে বাধা দেয়। তবে কেউ যদি খুশি হয়ে কিছু দেন তাহলে আমাদের মধ্যে আর্থিক সংকটে থাকা স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য অনেক ভালো হবে।’
বিডি/ও