টাকার চেয়ে জ্ঞানের আলো ছড়ানোই বড় এই মাস্টারের কাছে
Published : ১৬:৪৬, ৪ অক্টোবর ২০২৪
শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি উচ্চ শিখরে পৌঁছিতে পারে না। পিতা-মাতা সন্তান জন্ম দিলেও প্রকৃত পক্ষে সেই সন্তানকে সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তোলেন শিক্ষক। তাইতো শিক্ষককে মানুষ গড়ার কারিগড় বলা হয়। এমনি একজন শিক্ষক লুৎফর রহমান।
শিক্ষকের দায়বদ্ধ থেকে নিজের জীবন বা পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতার কথা চিন্তা না করে ৪৮ বছর আগে দিনে এক টাকা ফি নিয়ে শিক্ষার্থী পড়ানো শুরু করেন লুৎফর রহমান। এখন তার বয়স ৭৫। এর মধ্যে কত কিছুর দাম বাড়ল।
কিন্তু লুৎফর রহমানের প্রাইভেট পড়ানোর ফি আর বাড়েনি। এলাকার লোকজনের কাছে তিনি পরিচিতি পেয়েছেন এক টাকার মাস্টার নামে।
গুণি শিক্ষক লুৎফর রহমানের বাড়ি গাইবান্ধা সদর উপজেলার গিদারী ইউনিয়নের বাগুড়িয়া গ্রামে। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। কিন্তু পাঠদানের উৎসাহ এতটুকু কমেনি। প্রতিদিন আঙিনায় ৪০-৫০ জন শিক্ষার্থীকে পড়ান তিনি।
লুৎফর রহমান বলেন, এলাকার বেশির ভাগ মানুষ গরিব। ছেলেমেয়েদের পড়াতে চান না। প্রাইভেট পড়াতে পারেন না। তিনি নামমাত্র ফি নিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন। এতে তার তেমন লাভ না হলেও গরিব মানুষের ছেলেমেয়ে শিক্ষিত হচ্ছে।
এটাই তার লাভ। একসময় পেশা হিসেবে নিলেও এখন পড়ালেখা শেখানোই তার নেশা। কখনও হেঁটে, কখনও বাইসাইকেলে চড়ে ঘুরে ঘুরে শিশুদের পড়ালেখা করাচ্ছেন।
গাইবান্ধা জেলা শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বাগুড়িয়া গ্রাম। এ গ্রামের মধ্য দিয়ে ব্রহ্মপুত্র বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে।
বাঁধের দুই ধারে নদীভাঙা মানুষের বসবাস। বেশির ভাগ মানুষের একচালা টিনের ঘর। এখানকারই একটি বাড়ি লুৎফর রহমানের।
উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন তিনি। তার দেওয়া শিক্ষার আলোই আলোকিত হয়ে অনেকেই দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। হয়েছেন কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। শিক্ষাগুরু লুৎফর রহমান বলেন, প্রতিদিন সকালে পড়ানো শুরু করেন তিনি।
চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। ৪ দফায় প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির ৫০ জনকে পড়ান। তিনি একেক ব্যাচকে প্রায় ২ ঘণ্টা পাঠদান করেন।
কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, তারা দীর্ঘদিন ধরে লুৎফর রহমানের কাছে প্রাইভেট পড়ে। তার কাছে পড়তে টাকাপয়সা তেমন লাগে না। এ কারণে বাবা-মায়েরাও পড়তে পাঠান। পড়াশোনা ভালো হচ্ছে। শিক্ষার্থী দুর্জয় কুমারের বাবা রুইদাস কুমার পেশায় জেলে। সে জিইউকে স্কুলের ছাত্র।
দুর্জয় বলেন, অন্য স্যারের কাছে পড়লে মাসে ১০০০ টাকা লাগে। লুৎফর স্যারের কাছে প্রতিদিন এক টাকা লাগে।
অনেক শিক্ষার্থী বলেন, এ সময়ে এক টাকা দিয়ে কিছুই হয় না। ভিক্ষুকও এক টাকা নিতে চায় না। আর লুৎফর রহমান স্যার এক টাকায় পড়াচ্ছেন।
মধ্যবাগুড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শাহিন মিয়া বলেন, দীর্ঘদিন ধরে লুৎফর রহমানকে পড়াচ্ছে। তার পাঠদানের কারণে শিক্ষার্থীদের উপকার হচ্ছে। লুৎফর রহমান ১৯৭২ সালে ফুলছড়ি উপজেলার গুনভড়ি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন।
১৯৭৪ সালে গাইবান্ধা সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস। ১৯৭৫ সালে তিনি বিয়ে করেন। তখন তিনি ২৬ বছরের তরুণ। চাকরি না পেয়ে তিনি টিউশনি শুরু করেন। তখন ১০-১৫ জন শিক্ষার্থীকে দিন এক টাকা ফি নিয়ে পড়ানো শুরু করেন। লুৎফর রহমান বলেন, গরিব ও অবহেলিত এলাকায় জ্ঞানের আলো ছড়াতে পারছি।
এটাই আমার লাভ। যত দিন সুস্থ থাকব, তত দিন পাঠদান করে যাব। আমার ছাত্র অনেকেই ভালো ভালো জায়গায় গেছে। সরকারি ডাক্তার, প্রভাষক, কলেজের প্রিন্সিপালও হয়েছে।
এসব মনে হলে, আনন্দে সব কষ্ট ভুলে যাই। টাকার চেয়ে জ্ঞানের আলো ছড়ানোটাকে বড় তার কাছে।
লুৎফর রহমান আরও বলেন, আলুভর্তা দিয়ে পান্তা খেয়ে আর কতদিন থাকা যায়? এছাড়া কোনোদিন তাও জোটে না। ধারদেনা করে খাবার জোগাড় হয়। আমার ছাত্রদের কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, পুলিশ হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু আমার মতো এক টাকার মাস্টারের কিছুই হয়নি। লুৎফর রহমানের দুই ছেলে, দুই মেয়ে। মেয়েদের বিয়ে হয়েছে। এসএসসি পাস করার পর অর্থাভাবে লেখাপড়া করতে না পারা বড় ছেলে লাভলু মিয়া ব্যাটারি চালিত ইজিবাইক চালান।
ছোট ছেলে মশিউর রহমান একটি মাদ্রাসা থেকে মাস্টার্স সমমানের (দাওরা) পাস করে বেকার রয়েছেন। লুৎফরের স্ত্রী লতিফুল বেগম বলেন, তাঁর স্বামী সারা দিন টিউশনি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।
বাধা দিলে তিনি মন খারাপ করেন। ওটা তাঁর নেশা। বড় ছেলে ব্যাটারি চালিত ইজিবাইক চালিয়ে সংসারের জোগান দিচ্ছে।
এলাকাবাসী বলেন, একসময় ৮০ বিঘা জমি, পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা গরু সবই ছিল লুৎফর রহমান পরিবারের। ১৯৭৪ সালের বন্যা ও নদী ভাঙনে সব হারিয়ে নিঃস্ব হন তারা। পরে আশ্রয় নেন বাগুড়িয়া গ্রামের ওয়াপদা বাঁধে।
এলাকার জলিল উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি বলেন, ফজরের নামাজ পড়ে বাড়ি থেকে বের হন লুৎফর রহমান। এরপর পায়ে হেঁটে, কখনো বাইসাইকেল চালিয়ে পথ পাড়ি দেন তিনি।
বাগুড়িয়া, মদনেরপাড়া, পুলবন্দি, চন্দিয়া, ঢুলিপাড়া, কঞ্চিপাড়া, মধ্যপাড়া ও পূর্বপাড়াসহ কয়েকটি গ্রামের শিক্ষার্থী পড়ান।
খাজা মিয়া নামে আরেক প্রবীণ ব্যক্তি বলেন, শিক্ষানুরাগী লুৎফর রহমানের লক্ষ্য প্রাথমিকে ঝরে পড়াসহ ভাঙনকবলিত এলাকার সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষাদান। অভিভাবকদের বুঝিয়ে বই, খাতা, কলমসহ তাদের নিয়ে কখনো রাস্তার ধারে, বাঁধে কিংবা বসে পড়েন গাছ তলায়।
বর্তমানে তার ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ৪০-৫০ জন। প্রতি ব্যাচে ১০-১২ করে পাঠদান করেন। লুৎফর রহমানের সাবেক ছাত্র ও সমাজকর্মী
বদিয়াজ্জামান মিয়া বলেন, বিখ্যাত কিছু দার্শনিকের নাম জানি। যেমন, প্লেটো, সক্রেটিস। তারা গ্রামগঞ্জ-হাটে-বাজারে গিয়ে মানুষদের সমাবেত করে জ্ঞান দান করতেন।
ঠিক লুৎফর রহমানের পাঠদান পদ্ধতিটাও এ রকম। তিনি একজন ব্যতিক্রমী মানুষ। মাত্র এক টাকার বিনিময়ে এলাকায় শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছেন।
বিডি/ও