হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী খড়ের ঘর
Published : ২৩:৩১, ১০ ডিসেম্বর ২০২৪
আধুনিক যুগেও গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য ধরে রাখতে এখনো খড়ের তৈরি ঘরে বাসবাস করছে ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা রাজাগাঁও গ্রামে বেশ কয়েকটি পরিবার। কালের প্রবাহে দিন যতই যাচ্ছে, ততই হারিয়ে যেতে বসেছে খড়ের ছাউনির ঘর।
এক সময় দেশের প্রতিটি গ্রামে বা মহল্লায় সেই চিরচেনা খড়ের ঘরের প্রচলন ছিল। গ্রামের মানুষের বসবাসের জন্য খড়ের তৈরি ঘর ছাড়া চিন্তাই করা যেত না। গ্রাম বাংলায় মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকে ৯০ দশক পর্যন্ত বেশিরভাগ মানুষ খড়ের ঘরে বসবাস করতেন।
রূপসী গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য খড়ের ছাউনির তৈরি ঘর এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় কালের বিবর্তনে খড়ের তৈরি ঘর বিলুপ্তির পথে বললেই চলে।
কিন্তু শহরের রঙিন বাতি আর চাকচিক্যের মধ্যে যেখানে কোটি কোটি মানুষের বসবাস, ঠিক একই সময়ে পুরোনো ঐতিহ্য ও বাপ-দাদার স্মৃতিকে আগলে রাখতে সেই ৭০ বা ৮০’র দশকের খড়ের ঘরেই জীবনযাপন করছেন পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলা ধামোর ইউনিয়নের ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা রাজাগাঁও গ্রামের বেশ কয়েকটি পরিবার।
শুধু শোবার ঘরই নয়, রান্নাঘর, গোয়ালঘর এমনকি গোলাঘরও তারা তৈরি করেছেন খড় দিয়ে। অর্থবিত্ত, ধনসম্পদ ও ফসলি জমি থাকা সত্ত্বেও তৈরি করতে চান না পাকা দালান অথবা আধাপাকা টিনশেডের ঘর। কারণ তারা চান পুরোনো ঐতিহ্য ও বাপ-দাদার রেখে যাওয়া খড়ের ঘরগুলো এভাবেই স্মৃতি হিসেবে রয়ে যাক যুগ যুগ ধরে।
পাকা ও আধাপাকা ঘরের ইট, বালু, রড ও সিমেন্টসহ ইত্যাদি জিনিসের মতো এসব খড়ের ঘর তৈরি করতে তেমন কোনো উপকরণ লাগে না। শুধু বাঁশ ও ধান কাটার পরে ধানের খড়ই যথেষ্ট। খড়ের ঘর তৈরিতে লাগে না কোনো ইঞ্জিনিয়ার বা প্রকৌশলী। দরকার গ্রামের অভিজ্ঞ খড়ের ঘর তৈরি কারিগর।
এ ঘর তৈরি করতে ধান কাটার পর ধানের খড়গুলোকে প্রথমে রৌদ্রে শুকাতে হয়। পরে বিশেষ কায়দায় ধানের খড়গুলোকে সাজিয়ে কয়েকটি ধাপ ও বাঁশের মাধ্যমে দুটি ছাউনি তৈরি করা হয়। প্রথমে বাঁশের তৈরি বেড়ার ওপরে সেই সাজানো খড়গুলোকে বিছিয়ে দেওয়া হয়।
বিছানো খড়গুলোর উপরে আবার বাঁশের কয়েকটি অংশ দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দেওয়া হয়। যেন প্রবল ঝড়, বৃষ্টি অথবা বাতাসে খড়গুলো উড়ে যেতে না পারে। খড় তাপ কুপরিবাহী বলে শীতকালে খড়ের ঘর গরম থাকে। আসলে ঘরের চাল বানানোর সময় এর মধ্যে অসংখ্য বায়ু কুঠুরি তৈরি হয়, এগুলোতে বাতাস আটকে থাকে। যার কারণে গরমের সময় খড়ের ঘরে ঠান্ডা অনুভূত হয়।
আবার বাতাস তাপ কুপরিবাহী বলে ঘরের ভেতরের উত্তাপ বাতাসকে বাইরে বের হতে দেয় না, বাইরের উত্তাপ বাতাসকে ভেতরে প্রবেশ করতে বাধা দেয়, যার ফলে ঘরের ভেতরের বাতাস বের না হওয়ার কারণে খড়ের ঘরের ভেতরে শীতকালে গরম অনুভূত হয়।
খড়ের ঘরের মালিক আইনুল হক বলেন, এই ঘরে প্রায় ৪০ বছর ধরে বাস করে আসছি। পাকা বা আধা পাকা ঘর তৈরি করতে আমাদের যথেষ্ট পরিমাণ জায়গা সম্পদ রয়েছে। এই ঘরগুলো আমাদের বাপ-দাদার রেখে যাওয়া স্মৃতি। তারাও এসব ঘরে তাদের জীবন কাটিয়েছেন। এগুলো আমরা অসম্মান করতে পারি না। আমরা খড়ের ঘরে থাকতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।
আইনুল হক বলেন, এসব ঘর বেশ আরামদায়ক। শীতকালে গরম আর গ্রীষ্মকালে ঠান্ডা অনুভূত হয়। বর্ষার সময় বৃষ্টি এলে খড়ের ঘরে তেমন শব্দ পাওয়া যায় না। আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্য আর বাপ-দাদার পুরোনো স্মৃতিকে আগলে রাখার জন্য এসব ঘরে এখনো বসবাস করছি, যদিও আমাদের পাকা ঘর তৈরি করতে কোনো অর্থ-স¤পদের অভাব নেই।
মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে জীবন মানেরও উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু মানুষ তার নতুনত্বকে বরণ করতে গিয়ে এখন হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামবাংলার চিরচেনা ঐতিহ্যবাহী খড়ের ঘর। যা হয়তো আর দেখা মিলবে না আগামী নতুন প্রজন্মের চোখে।
বিডি/ও