শিশুদের জীবন রক্ষার কৌশল সাঁতার

শিশুদের জীবন রক্ষার কৌশল সাঁতার

নিজস্ব প্রতিবেদক

Published : ১৭:২৮, ৮ জুলাই ২০২৪

নদীমাতৃক বাংলাদেশে একসময় বুক চিড়ে বয়ে যেতো ছোট-বড় অসংখ্য নদী। জীবন-জীবিকার তাগিদে প্রায় সব কিছুই ছিল নদীকেন্দ্রিক। ফলে দেশের মানুষ হাঁটা-চলা শেখার মতোই জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে সাঁতার শিখতো। কিন্তু নদ-নদী কিংবা জলাধার সংকুচিত হয়ে যাওয়া বড় বড় শহরে, এমনকি মফস্বল শহরেও সাঁতার শেখার সুযোগ সীমিত হয়ে গেছে।

ফলে, অনেকে সাঁতার শেখার গুরুত্ব সম্পর্কে ভুলে যাচ্ছেন। কিন্তু বিভিন্ন দুর্যোগের সময় সাঁতার যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা উপলব্ধি করা যায়। প্রায় প্রতি বছর নৌকাডুবিতে কিংবা পানিতে ডুবে অসংখ্য মৃত্যুর খবর দেখতে পাওয়া যায়।
ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর বাংলাদেশে গড়ে ১৭ হাজার শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। এ মৃত্যুর সংখ্যা বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ। যা মোট শিশুমৃত্যুর ২৮ শতাংশ। এ মৃত্যুর অধিকাংশ খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় না।

বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাস্থ্য ও তথ্য জরিপ ২০১৬ অনুযায়ী, বছরে ১ থেকে ১৭ বছর বয়সী ১৪ হাজার ৪৩৮ জন শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়।

ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপিস, জন হপকিন্স ইন্টারন্যাশনাল ইনজুরি রিসার্চ ইউনিট, দ্য সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বা সিআইপিআরবি এবং ইন্টারন্যাশনাল ড্রাউনিং রিসার্চ সেন্টার বা আইসিডিডিআর’বির এক গবেষণায় জানা যায়, শিশুদের ক্ষেত্রে ০-১৭ বছর বয়সীরা ডুবেই মারা যায় বেশি। প্রতি বছর ১৪ হাজারের মতো শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন ৪০ জন শিশু প্রাণ হারায় পানিতে ডুবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ২০১৭ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বছরে ৩ লাখ ৬০ হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়, যার ৯০ শতাংশ ঘটে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে।

বৈশ্বিক তথ্য অনুযায়ী, পানিতে ডুবে সবচেয়ে বেশি মারা যায় ১ থেকে ৪ বছরের শিশুরা এবং দ্বিতীয় ঝুঁকিপূর্ণ বয়স হলো ৫ থেকে ৯ বছর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৭ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মেয়ে শিশুদের তুলনায় দ্বিগুণ ছেলে শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়।

শিশুদের এক প্রকার নীরব মহামারি হচ্ছে পানিতে ডুবে মৃত্যু। এ মৃত্যু ঠেকাতে শিশুকে সাঁতার শেখানোর কোনো বিকল্প নেই। মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলা প্রশাসন বিষয়টিকে মাথায় রেখে সিঙ্গাইর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সহযোগিতায় শিশুদের সাঁতার শেখানোর উদ্যোগ গ্রহণ করে।

এ বিষয়ে উপজেলা শিক্ষা অফিসার, প্রাথমিক শিক্ষক ও কয়েকজন অভিভাবকের সঙ্গে আলোচনাকালে অভিভাবকগণ ব্যাপক আগ্রহ প্রকাশ করেন। সাঁতার শেখানোর উদ্যোগের কথা শুনেই সিঙ্গাইর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রথমদিনে ৫৫টিরও বেশি আবেদন জমা পড়ে।

উপজেলার পুকুরে সপ্তাহের প্রতি শুক্রবার ও শনিবার এ প্রশিক্ষণ চলে। ফায়ার সার্ভিসের নিরাপত্তা সরঞ্জামের বলয়ে শিশুদের এ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বাড়তি নিরাপত্তা হিসেবে রাখা হয়েছে নৌকা।

সিঙ্গাইর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পারভীন আরা ভূইয়া বলেন, ‘সাঁতার শেখানোর এই চমৎকার উদ্যোগে আমাদের শিক্ষার্থীদের যে কী উপকার হলো, তা বলে বোঝানো যাবে না।’

সিঙ্গাইর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থীর বাবা এবং উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসার ফারুক হোসেন বলেন, ‘আমি আমার ছেলেকে দীর্ঘদিন যাবৎ সাঁতার শেখানোর কথা ভাবছিলাম। কিন্তু কোথাও সুযোগ পাচ্ছিলাম না। উপজেলা প্রশাসনের এ উদ্যোগের ফলে আমার ছেলে এখানে সাঁতার শিখতে পেরেছে। আমি কিছুটা চিন্তামুক্ত হতে পারলাম।’

সিঙ্গাইর থানার উপপরিদর্শক ও সিঙ্গাইর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থী দিগন্ত সান্যালের বাবা দীপংকর সান্যাল বলেন, ‘শহরকেন্দ্রিক সমাজে নিজেদের ব্যস্ততার কারণে আমরা ছেলেমেয়েদের সাঁতার শেখানোর সময় এবং সুযোগ পাই না। কিন্তু সাঁতার শেখার কোনো বিকল্প নেই। এটি একটি অসাধারণ সুযোগ তৈরি হলো।’

উপজেলা নির্বাহী অফিসার দিপন দেবনাথ বলেন, ‘গত কিছুদিন আগে সিঙ্গাইর উপজেলায় কয়েকটি শিশু সাঁতার না জানায় পানিতে ডুবে মারা যায়। বিষয়টি আমাকে ব্যথিত করে। আমি ছোটবেলায় নিজেদের পুকুরে সাঁতার শিখেছি। অথচ শিশুরা সাঁতার শিখতে পারছে না। উপজেলা সদরের অধিকাংশ শিশুই সাঁতার জানে না। তাই এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শিশুদের সাঁতার শেখার গুরুত্বের ব্যাপারে সবাইকে সচেতন হতে হবে। কারণ সাঁতার জানা মানে অদৃশ্য এক হাতিয়ার সঙ্গে থাকা। তাছাড়া সুন্দর মন ও সুস্থ দেহ গঠনে সাঁতার খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যায়াম।’

উপজেলা চেয়ারম্যান মুশফিকুর রহমান খান বলেন, ‘সিঙ্গাইর উপজেলা প্রশাসনের অসংখ্য ভালো উদ্যোগের একটি হলো শিশুদের সাঁতার শেখানো। একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হতে হলে সাঁতার শিখতেই হবে।’

বিডি/এন

শেয়ার করুনঃ
Advertisement