১৯৭১-এর দায়ে ক্ষমা ও ক্ষতিপূরণের প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেলো পাকিস্তান

Published : ২২:৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৫
ঢাকায় বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের আনুষ্ঠানিক বৈঠক—ফরেন অফিস কনসালটেশন (এফওসি)। বৈঠক শেষে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনার দাবি ও স্বাধীনতাপূর্ব অভিন্ন সম্পদের বকেয়া অর্থের প্রসঙ্গ গুরুত্বসহকারে তুলে ধরা হয়। তবে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে প্রকাশিত বিবৃতিতে এসব অমীমাংসিত বিষয় নিয়ে কোনো ধরনের মন্তব্য করা হয়নি।
ইসলামাবাদের বক্তব্যে অতীতের বিতর্কিত অধ্যায়গুলোকে পাশ কাটিয়ে ভবিষ্যতের সম্ভাবনা, পারস্পরিক সাংস্কৃতিক সম্পর্ক এবং অভিন্ন ইতিহাস ও জনআকাঙ্ক্ষার দিকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলে দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আলোচনা হলেও, সেগুলোর সমাধান কিংবা স্বীকৃতি নিয়ে ফের অনিশ্চয়তা থেকেই গেল। খবর বিবিসির।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেড় দশক পর হওয়া এ বৈঠকে ইসলামাবাদের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের জন্য অমীমাংসিত বিষয়ের সমাধান চেয়েছে বলে বৈঠক শেষে এক ব্রিফিংয়ে জানান বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিন।
জসীম উদ্দিন জানান, স্বাধীনতাপূর্ব ক্ষতিপূরণ হিসেবে বাংলাদেশ পাকিস্তানের কাছে চার দশমিক তিন দুই বিলিয়ন বা ৪৩২ কোটি ডলার চেয়েছে। এছাড়া, এফওসিতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের নৃশংসতার জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়ার বিষয়ও তুলেছে ঢাকা।
একদিন পর শুক্রবার পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ষষ্ঠবারের মত অনুষ্ঠিত হওয়া পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক সম্পর্কে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে পুনরুজ্জীবিত করতে যৌথ অঙ্গীকার প্রতিফলিত হয়েছে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিভিন্ন দিক, গাজায় ইসরাইলি হামলার নিন্দা এমনকি জম্মু ও কাশ্মীর ‘ভারতের অবৈধ দখলে’ রয়েছে দাবি করে এর সমাধানের মত ইস্যু নিয়ে ঢাকার বৈঠকে আলোচনার কথা বলা হলেও মুক্তিযুদ্ধে ‘গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাওয়া’ কিংবা ‘বকেয়া অর্থের’ বিষয়ে কিছু বলা নেই ওই প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচের সঙ্গে বৈঠক শেষে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিন জানিয়েছিলেন, আলোচনায় অমীমাংসিত বিষয়ের মধ্যে ছিল, ‘আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসন, অবিভক্ত সম্পদের সুষম বণ্টন, ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রেরিত বৈদেশিক সাহায্য তহবিল হস্তান্তর এবং ১৯৭১ সালে তৎকালীন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে জনসমক্ষে ক্ষমা চাওয়া।’ তিনি বলেন, বাংলাদেশের আগের একটি হিসাবে ৪০০ কোটি ডলার এবং আরেকটা হিসাবে ৪৩২ কোটি ডলার। এ হিসাব আলোচনায় বলেছি।
তবে, এসব ইস্যুতে একটি শব্দও ব্যয় করেনি পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে, অতীতের ইস্যুর চেয়ে ভবিষ্যতের সম্ভাবনার দিকেই বেশি নজর দিয়েছে ইসলামাবাদ। তাদের ভাষ্য, দেশ দুটির সাংস্কৃতিক সম্পর্ক এবং অভিন্ন ইতিহাস ও জনআকাঙ্ক্ষার কথা এসেছে আলোচনায়।
প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, বৈঠকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত ও কৌশলগত সহযোগিতা নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করেছে দুই পক্ষ। সাম্প্রতিক কয়েকটি উচ্চ পর্যায়ের যোগাযোগের প্রসঙ্গও এসেছে সেখানে। নিউইয়র্ক, কায়রো, সামোয়া ও জেদ্দার ওই সব আলাপ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করতে সহায়তা করেছে।
সম্পর্কের গতিশীলতা ধরে রাখতে নিয়মিত প্রাতিষ্ঠানিক সংলাপ, ঝুলে থাকা চুক্তি দ্রুত চূড়ান্ত করা এবং বাণিজ্য, কৃষি, শিক্ষা ও কানেক্টিভিটির (সংযোগ) ক্ষেত্রে সহায়তা বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, বলে জানিয়েছে ইসলামাবাদ।
পাকিস্তানের পক্ষ থেকে দেশটির কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলাদেশিদের পড়াশোনার সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
আর, বাংলাদেশ প্রস্তাব দিয়েছে মৎস্য ও সামুদ্রিক বিষয়ে কারিগরি প্রশিক্ষণের। কানেক্টিভিটিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথাও বলেছে দেশ দুটি।
করাচি ও চট্টগ্রামের মধ্যে সরাসরি জাহাজ চলাচল শুরুর বিষয়টিকে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি আকাশপথে ফের সরাসরি যোগাযোগ চালুর ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। সন্তোষ জানানো হয়েছে, ভ্রমণ ও ভিসা সহজীকরণে অগ্রগতির ব্যাপারে। বৈঠকে সার্ক এবং কাশ্মীর প্রসঙ্গেও আলাপ হয়েছে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, উভয় দেশ সার্ক পুনরুজ্জীবনের প্রয়োজনীয়তার কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে।
ইসলামাবাদের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, পররাষ্ট্র সচিব বাংলাদেশকে ভারতের অবৈধ দখলে থাকা জম্মু ও কাশ্মিরের পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেছেন। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব এবং কাশ্মিরী জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী দ্রুত এর সমাধানের ওপর জোর দেন তিনি।
ফিলিস্তিনি এলাকা বিশেষ করে গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন ও গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিন্দা জানিয়েছে দুই দেশ।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচের সাক্ষাতের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে বিজ্ঞপ্তিতে।
আরও জানানো হয়, দুই দেশের মধ্যে পরবর্তী ফরেন অফিস কনসালটেশন ২০২৬ সালে ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত হবে।
এনই