বাংলাদেশের ক্রিকেটের সমস্যা সমাধানে ৭ দফা প্রস্তাব
Published : ২০:১৫, ৮ জুলাই ২০২৪
উদয় হাকিম: ২০২৩ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে মোটেও ভালো করতে পারেনি বাংলাদেশ। সেমির আশা নিয়ে খেলতে গিয়ে অনেক কষ্টে অষ্টম স্থান নিয়ে ফিরতে হয়েছে। ভক্তরা হতাশ হয়েছেন। কিন্তু ক্রিকেট বোদ্ধারা হতাশ হননি, কারণ বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের সামর্থ্য ওইটুকুই। অনেকেই ক্রিকেট বোর্ড কর্মকর্তা এবং কোচিং স্টাফদের মুন্ডুপাত করেছেন বটে, কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছু হবে বলে মনে হচ্ছে না।
যা-হোক, সম্প্রতি শেষ হওয়া বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের যে দুর্বলতাগুলো ফুটে উঠেছে, সে-সব বিশ্লেষণ করে দেখা যাক। এসব সমস্যা চিহ্নিত ও তার সমাধান করতে পারলে বাংলাদেশও এক সময় ভালো দলে পরিণত হবে।
০১. ভালো পিচে খেলে অভ্যস্ত নয় বাংলাদেশ। স্লো-ড্যাম উইকেটে খেলে ফাস্ট, বাউন্সি উইকেটে গিয়ে খাবি খায় টাইগার ব্যাটসম্যানরা, সাহস পান না। যে বলটা বাউন্ডারির বাইরে ফেলার কথা, সেটা ফেলে দেয় ভেতরেই। অনাহুত বল উড়িয়ে মারে।
এ সমস্যার সমাধান করতে হলে দেশেই ভালো (বাউন্সি-ফাস্ট) উইকেট বানাতে হবে। স্থানীয় নয়, বৈশ্বিক অঙ্গনে ভালো করার লক্ষ্য থাকতে হবে। বিশ্বের সঙ্গে লড়তে হলে বিশ্বমানের উইকেট দরকার।
০২. বাংলাদেশের বোলারদের সবচেয়ে বড় সমস্যা শর্ট বল করা। অনেক বল দেখা যায় মাঝপিচও অতিক্রম করে না। এসব বল করে বিশ্বমানের ক্রিকেটারদের ভয় দেখানো যাবে না। মোদ্দা কথা, শর্ট বল পেলে সাধারণ মানের একজন ব্যাটসম্যানও ছক্কা মারার ধান্ধা করে। যে কারণে শর্ট পিচ বল দিয়ে খরচে বোলারের তালিকায় স্থান পান বাংলাদেশের পেসাররা।
শর্ট বল করা বন্ধ করতে হবে। বেশি বেশি ইয়র্কার অনুশীলন করতে হবে। যাকে তাকে ধরে এনে পেস বোলিং কোচ বানিয়ে লাভ নেই। গুড লেন্থ, ইন সুইং-আউট সুইং, স্লোয়ারসহ যত রকমের ভ্যারিয়েশন আনা যায় সেই চেষ্টা করতে হবে। গায়ের জোরে নয়, বল করতে হবে মাথার জোরে।
০৩. প্রায়ই শোনা যায়, স্পিন বল অথচ স্পিন করে না। বাংলাদেশ সব সময় স্পিননির্ভর পিচ বানায়। কিন্তু তারপরও বিশ্বমানের একজন স্পিনার নেই আমাদের। অবস্থা এমন যে, বল করার সময় স্পিনার নিজে ঘোরে কিন্তু তার ডেলিভারি করা বল ঘুরে না! ভাবটা এমন যে, কোনো রকম বলটা ছেড়ে দিলেই হলো!
যিনি ভালো স্পিনার, তিনি সব উইকেটেই বল স্পিন করাতে পারবেন। সুতরাং স্পিনিং উইকেট নয়, ফাস্ট বোলিং উইকেট বানিয়ে সেখানে স্পিন করা সেখাতে হবে। শেন ওয়ার্ন, মুরলীধরন এর উদাহরণ। বস্তায় বস্তায় অকার্যকর অফ স্পিনার বানিয়ে লাভ নেই। ভালো স্পিন বোলিং কোচ এনে সম্ভাবনাময় তরুণদের সুযোগ দিতে হবে তার অধীনে দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ নেওয়ার। লেগ স্পিনার, গুগলি বোলারদের খুঁজে বের করে সামনে নিয়ে আসতে হবে।
০৪. ধৈর্য নেই বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের। যে যত বড় ব্যাটসম্যান, সে তত অসহিষ্ণু। কেউ ৩০/৪০ রান হয়ে গেলেই ভাবেন তার কাজ শেষ হয়ে গেছে। অথচ ম্যাক্সওয়েলের মতো গ্রেটরা সেঞ্চুরি হয়ে গেলেও মনে করেন তার কাজ শেষ হয়নি। ইনিংস বড় করার মানসিকতা আছে এমন খেলেয়াড়দের প্রমোট করা উচিত।
ক্রিকেট খেলায় ধৈর্যই আসল পরীক্ষা। জাতীয় দলে তাদেরই নেওয়া উচিত যাদের বড় ইনিংস খেলার মানসিকতা আছে। ফিফটি হয়ে গেলে সে উচ্চাকাঙ্ক্ষী হবে না। সেঞ্চুরি হয়ে গেলে আনন্দে পাগল হয়ে যাবে না। পরিস্থিতি বুঝে নিজের জন্য, দেশের জন্য বড় ইনিংস খেলতে হবে।
০৫. বিগ হিটার নেই। ৪০ বলে যখন ৮০ রান দরকার। এমন পরিস্থিতিতে ম্যাচ শেষ হওয়ার আগেই বাংলাদেশ হেরে যায়। যারা উইকেটে থাকে তারা তখন আর দলের জন্য, দেশের জন্য খেলে না; কিছু রান করে নিজের সংগ্রহ বাড়াবে, উইকেটে টিকে থাকবে সেই চেষ্টা করেন।
বিগ হিটার তৈরি করতে হবে। যাদের জোরে মারার সামর্থ্য আছে, শারীরিক সক্ষমতা আছে, তাদের প্রমোট করতে হবে। নিজের জন্য নয়, দলের জন্য, দেশের জন্য জয়ের মানসিকতা নিয়ে খেলতে হবে। কেউ নিজের জন্য খেলতে চাইলে তাকে একাদশ থেকে বাদ দিতে হবে।
০৬. ব্যাপক সমালোচনা হয় বাংলাদেশের দল নির্বাচন নিয়ে। গত ২৫ বছর ধরেই এটা চলছে। দল নির্বাচনে অনিয়মের কারণে ভক্তরা বিরক্ত হয়ে থাকে নির্বাচকদের ওপর। অনেক সময় জনরোষে দলে পরিবর্তনও হয়। আবার সমালোচনা হয় একাদশ নিয়েও। একজনও ব্যাকআপ ওপেনার নেই! এরকম দল বোধহয় এবারের বিশ্বকাপে কেবল বাংলাদেশই ছিল।
দল নির্বাচন এবং একাদশ নির্বাচনে স্বচ্ছ হতে হবে। ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে প্রাধান্য না দিয়ে দেশের কথা, জয়ের কথা ভাবতে হবে। তামিম ইকবালকে নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্কে প্রমাণ হয়েছে যে, বোর্ড ও নির্বাচকরা ভুল করেছেন। তাতে দলের মনোবল ভেঙে গিয়েছিল আগেই। সবাই যেখানে মনোবল বাড়াতে মনোবিজ্ঞানী নিয়োগ দেন, আমরা সেখানে দলের মনোশক্তি খর্ব করে দেই।
০৭. কোচ-অধিনায়কের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে দলে কোনো কম্বিনেশন ছিল না। মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো ব্যাটিং অর্ডার, বোলিং অর্ডার চলেছে। একদিন কেউ সাত নম্বরে খেলছেন, পরের ম্যাচে তিনি ওপেনিংয়ে। সিনিয়রদের মূল্যায়ন দূরে থাক, তাদের দল থেকে বাদ দেওয়ার ভয় দেখিয়ে রাখা হয়েছিল। ফলে তাদের কাছ থেকে স্বতস্ফূর্ত পারফরমেন্স পাওয়া যায়নি।
সব ধরনের স্বেচ্ছাচারিতার অনুশীলন বন্ধ করতে হবে। কোচ-অধিনায়কের ক্ষমতার ভারসাম্য থাকতে হবে। একাদশ নির্বাচনে জয়ের বিষয়টিই কেবল মাথায় থাকা উচিত। কোনো খেলোয়াড়কে অপরিহার্য মনে করে অসীম ক্ষমতা দেওয়া যাবে না। দলে গণতান্ত্রিক চর্চা জরুরি।
লেখক: সম্পাদক ঢাকা বিজনেস ও করপোরেট ব্যক্তিত্ব
বিডি/এন