বইমেলায় কেন যাবেন

বইমেলায় কেন যাবেন

আবু মকসুদ

Published : ১৩:৩৬, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

বইমেলায় কেন যাবেন? এটি একটি সাধারণ প্রশ্ন হলেও এর উত্তর অত্যন্ত গভীর এবং ব্যক্তিগত। যাবেন এজন্য যে একদিন আপনার জন্ম হয়েছিল মানুষের ঘরে, এরপর ধীরে ধীরে আপনি মনুষ্য রূপে বিকশিত হয়েছেন। সেই বিকাশের পথে বইয়ের ভূমিকা ছিল অপরিহার্য। আপনার জীবনের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে, শৈশব থেকে শুরু করে কৈশোর, যৌবন এবং বার্ধক্য পর্যন্ত, বই আপনাকে সঙ্গ দিয়েছে, আপনাকে গড়ে তুলেছে, আপনার চিন্তা-চেতনা ও অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করেছে। তাই, বইমেলায় যাওয়াটা শুধু বই কেনার একটি ঘটনা নয়, এটি হলো নিজের জীবনের সঙ্গে পুনঃসংযোগ স্থাপন করা।

আপনি হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন, বই কিভাবে আপনার জন্মের পরে এত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে? আসুন, দু-একটি উদাহরণের মাধ্যমে এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি। ধরুন, আপনার বয়স মাত্র এক মাস। আপনার মা তখন অত্যন্ত ক্লান্ত, আপনাকে ঘুম পাড়ানোর জন্য তিনি নানাভাবে চেষ্টা করছেন। তখন তিনি আপনাকে শোনালেন একটি জনপ্রিয় ছড়া 'ঘুম পাড়ানি মাসি-পিসি/ মোদের বাড়ি এসো, /খাট নাই পালং নাই খোকার চোখে বসো।/ বাটা ভরে পান দিবো/ গাল ভরে খেয়ো, খোকার চোখে ঘুম নাই/ ঘুম দিয়ে যেয়ো।' এই যে ছড়াটি, এটি আপনার মাকে তার মা শিখিয়েছিলেন, এবং সেই ছড়াটি এসেছে বইয়ের পাতা থেকে। আপনার মায়ের কাছে এই ছড়াটি একসময় একটি মন্ত্রের মতো কাজ করেছিল, এখন তা আপনার জন্যও একইভাবে কাজ করছে। এইভাবে, বইয়ের ছড়া আপনার শৈশবের প্রথম অভিজ্ঞতাগুলোর সঙ্গে মিশে গেছে।

এরপর আসুন একটু বড় হই। বয়স পাঁচ বছর, বাবার হাত ধরে প্রথমবার স্কুলে যাচ্ছেন। সেদিন আপনি শিখলেন 'জল পড়ে পাতা নড়ে'—একটি সরল বাক্য, যা শুধু ভাষার শিক্ষা নয়, প্রকৃতিরও এক অদ্ভুত সাযুজ্য শেখায়। স্কুল থেকে ফেরার পথে হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়, এবং আপনি লক্ষ করলেন কচু গাছের পাতা বৃষ্টির জলে নড়ছে। তখন আপনার মনে পড়ল, স্কুলে শোনা সেই লাইনটি কতটা সত্যি। এই ছোট্ট লাইনটি শুধুমাত্র আপনার শৈশবের মস্তিষ্কে এক গভীর দর্শনের বীজ বুনেছিল, যা আপনি পুরো জীবন ধরে বহন করবেন। 

এরপর, আপনার বয়স দশ বছর। মক্তবে হুজুরের কাছে আরবি পড়ছেন। আপনার পাশে বসা একটি মেয়ে, যার চুল খোলা, আপনাকে অদ্ভুতভাবে আকর্ষণ করছে। আপনি ভাবছেন, কেন সে আপনাকে একবারও চোখ তুলে দেখছে না। এই অনুভূতি হয়তো আপনার মধ্যে নতুন, কিন্তু ঘরে ফিরে যখন বড় ভাইয়ের মুখে আল মাহমুদের কবিতা শোনেন, 'কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুল খোলা আয়েশা আক্তার', তখন হঠাৎ করে সেই মেয়েটির কথা আপনার মনে পড়ে। আল মাহমুদের কবিতায় যে মেয়েটির কথা বলা হয়েছে, তার সঙ্গে আপনার মনে থাকা মেয়েটির অবয়ব যেন মিলে যায়। এভাবেই বই আপনার জীবনের অভিজ্ঞতাকে প্রতিফলিত করে, আপনাকে এক গভীর সংযোগের দিকে নিয়ে যায়।

তারপর ধরুন, সদ্যমেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে আপনি বন্ধুর গ্রামের বাড়িতে গেছেন। দুপুরবেলা বিরাট পুকুরে একটি কিশোরী সাঁতার কাটছে, সূর্যের আলো তার উপর পড়ে উজ্জ্বল দৃশ্য তৈরি করছে। তার এই আনন্দ উল্লাস সাঁতারে আপনি অবাধ স্বাধীনতা দেখছেন। এই দৃশ্য আপনার মনে শামসুর রাহমানের 'স্বাধীনতা তুমি' কবিতার লাইনগুলোকে জীবন্ত করে তোলে। আপনার কাছে কবিতার 'রোদেলা দুপুর' এবং সেই দৃশ্য বাস্তবে মিলেমিশে যায়। তখন আপনি ভাবেন, কবিরা কীভাবে এত গভীর এবং বাস্তব অভিজ্ঞতাগুলোকে এত সুন্দরভাবে কবিতায় তুলে ধরেন? আপনার ভেতরেও সেই অভিজ্ঞতা থেকে কবিতা রচনার ইচ্ছা জাগ্রত হতে থাকে।

তারপর একদিন হঠাৎ করে আপনি প্রেমে পড়লেন। কলেজের তরুণীর সঙ্গে আপনার প্রেম শুরু হলো। দুজনেই প্রতিজ্ঞা করেছেন, সততার সঙ্গে এই সম্পর্কটি এগিয়ে নিয়ে যাবেন। কিন্তু একদিন দেখলেন, আপনার প্রেমিকা আপনাকে ছেড়ে চলে গেছে। তার সঙ্গে থাকা প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি স্মৃতি তখন আপনার মনে আঘাত করে। আপনি যখন নিজের ঘরে ফিরে ক্লান্তভাবে জীবনানন্দ দাশের কবিতা হাতে তুলে নেন, তখন 'নীলাঞ্জনা ওইখানে যেও নাকো তুমি' পড়তে পড়তে আপনার চোখে জল চলে আসে। কবিতার সেই নীলাঞ্জনার সঙ্গে আপনার জীবনের বিচ্ছিন্ন প্রেমিকার অবয়ব মিশে যায়। কবিতার মধ্যে আপনি আপনার বেদনা খুঁজে পান, যা আপনাকে সান্ত্বনা দেয়।

একদিন আপনার বিয়ে হল। ফুটফুটে পরীর মত একটি মেয়ে আপনার ঘরের ঘরণী হয়ে এলো। আপনি সারাদিন কাজের ব্যস্ততায় ডুবে থাকেন, তাই চাইলেও বউকে সময় দিতে পারেন না। তবুও মনে মনে প্রত্যাশা করেন, সে আপনাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসবে। খেতে বসলে হাত পাখা দিয়ে বাতাস করবে, প্রতিদিন আপনার জন্য অপেক্ষা করবে। কাজের চাপ আর ক্লান্তি নিয়ে আপনি ঘুম-অঘুমের মধ্যে দিন কাটান। গভীর রাতে বাড়ি ফিরলে আশা করেন, কেউ একজন দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকবে, আপনার চোখের ক্লান্তি দেখে মমতাভরা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করবে, 'তোমার চোখ এত লাল কেন?' দেখুন আপনার এই ভাবনা কবিতায় কত সুন্দর করে বিন্যস্ত করেছেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। 

আপনি হয়তো আপনার জীবনের কোনো পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর বুকের মাঝে যেমন ছিল একটি মুক্ত, স্বাধীন, সবুজ ও কোমল বাংলাদেশ, তেমনি আপনিও হয়তো সেই সোনার বাংলার স্বপ্ন নিজের হৃদয়ে লালন করেছেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন দেশের স্বাধীনতার প্রতীক, তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপে ফুটে উঠত স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য গভীর ভালোবাসা। তাঁর অনুপ্রেরণা আজও বাঙালির হৃদয়ে বেঁচে আছে, যেন একটি মশাল, যা যুগ থেকে যুগান্তরে আলো ছড়িয়ে চলেছে। আপনার হৃদয়ের মাঝে বঙ্গবন্ধুর সেই দৃঢ় প্রত্যয় ও সাহসিকতা আজও জীবন্ত। বাংলাদেশকে ভালবাসার যে শপথ আপনি নিয়েছিলেন, সেটি বঙ্গবন্ধুর সেই চিরন্তন আদর্শের সঙ্গেই গভীরভাবে জড়িত। আপনি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশের গর্বিত অংশীদার, তার সোনালি ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শক। কবি আতাউর রহমান মিলাদের কবিতায় আপনি পুনরায় বঙ্গবন্ধুকে চিনে নিতে পারেন 'তাঁর কথা যতই লিখি/ ততোই আপন হয়ে উঠেন,/ এ এক আশ্চর্য নিয়ম/ অবিশ্বাস্য রকম আত্মবিশ্বাসী মানুষ/ নিজের ছায়ার চেয়ে/ দীর্ঘ হয়ে ফুটেন।

আপনি শুনলেন ফাতেমা তুজ জোহরা গাইছেন 'আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই'। আপনি প্রথমে ভেবেছিলেন, এটি নিশ্চয়ই এক ধরনের অলঙ্কার, বাস্তবিক কিছু নয়। কিন্তু যখন আপনি বাস্তবিকভাবে পাহাড়ের দিকে তাকালেন, তখন দেখলেন, আকাশ সত্যিই পাহাড়কে স্পর্শ করছে। প্রকৃতির সঙ্গে কবির চিন্তা মিলে যায়, এবং আপনি কবির সেই গভীর পর্যবেক্ষণের প্রশংসা করতে বাধ্য হন।

জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে, একসময় হয়তো আপনিও কবির মতো মৃত্যুকে মহামান্বিত হিসেবে গ্রহণ করবেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, 'মরণ রে, তুঁহু মম শ্যামসমান'। যখন আপনার জীবনের শেষ দিনগুলো ঘনিয়ে আসবে, তখন এই কথাগুলো হয়তো আপনার জীবনের যাত্রার এক সান্ত্বনাদায়ক সমাপ্তি হিসেবে ধরা দেবে। হয়তো আপনার প্রিয়জন আপনার হাত ধরে থাকবে, কিন্তু আপনি জানবেন যে এই যাত্রা থেকে পালানোর কোনো উপায় নেই। আপনার জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো এবং বইয়ে পড়া কবিতাগুলো একত্রে মিলে আপনাকে সেই শেষ যাত্রায় সঙ্গ দেবে।

এই সবকিছু মিলিয়ে, মেলায় যাওয়াটা কেন গুরুত্বপূর্ণ? বইমেলা শুধুমাত্র একটি জায়গা নয় যেখানে বই কেনা হয়, এটি এমন একটি স্থান যেখানে আপনি নিজের জীবনের স্মৃতিগুলো পুনরুদ্ধার করতে পারেন। মায়ের কোলে ফিরে যাওয়া, প্রথম স্কুলের দিনটিকে মনে করা, প্রথম বৃষ্টিতে ভিজে প্রেমিকাকে চিঠি লেখার সেই অনুভূতি—সবকিছুই বইয়ের সঙ্গে জড়িত। বইমেলায় যাওয়া মানে সেই সমস্ত স্মৃতির কাছে ফিরে যাওয়া, নিজের জীবনের সঙ্গে পুনরায় সংযোগ স্থাপন করা। 

বই শুধু একটি মাধ্যম নয়; এটি আমাদের জীবন, আমাদের অভিজ্ঞতা, আমাদের আবেগকে ধারণ করে। তাই মেলায় যাওয়া মানে শুধু নতুন বই কেনা নয়, বরং নিজের জীবনকেও নতুনভাবে যাচাই করা।

লেখক: কবি ও গদ্যকার

এনই

শেয়ার করুনঃ
Advertisement