বন্যাদুর্গতদের সুদমুক্ত ঋণ দিন
Published : ১৯:০৭, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪
জীবন বাঁচাতে সবকিছু ফেলে ঘর ছেড়েছিলেন বন্যাদুর্গত বহু মানুষ। পানি সরে যাওয়ায় তারা যখন নিজেদের বসতভিটায় ফিরে গেছেন, ততক্ষণে সেখানে আর কিছুই নেই। অনেকের ঘর ভেসে গেছে। কারও ঘরের ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক, যেগুলো সংস্কার ছাড়া বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। কৃষকের ফসল, মাছ, গবাদিপশুসহ সব হারিয়েছেন তারা। আয়-রোজগারের শেষ অবলম্বনটুকুও হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন অনেকেই।
দুর্গত মানুষদের ত্রাণ বিতরণের পাশাপাশি পুনর্বাসনের জন্য সরকারি-বেসরকারিভাবে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এগুলো প্রশংসনীয়। কিন্তু এর সঙ্গে তাদের সহজ শর্তের সুদমুক্ত ঋণ দেওয়া হলে পুনর্বাসনের জন্য সেটি হবে আরও বেশি কার্যকর ও উপকারী। অন্তত দুই লাখ বন্যাদুর্গত পরিবারের মধ্যে সুদমুক্ত ঋণ বিতরণ করা গেলে তারা সহজে পুনর্বাসিত হতে পারবেন। অর্থাৎ ক্ষতিগ্রস্তদের যে পরিমাণ ঋণ দেওয়া হবে, সেই একই পরিমাণ টাকাই তারা ছোট ছোট কিস্তিতে পরিশোধ করবেন; অতিরিক্ত একটি টাকাও দিতে হবে না। অনেকে হয়তো বলবেন, এটা সম্ভব না। আমি বলব এটা সহজ এবং সম্ভব। এ জন্য দরকার সবার সদিচ্ছা আর সরকারের একটুখানি উদ্যোগ।
‘মসজিদ ডট লাইফ’ সফলভাবে কাজটি করে যাচ্ছে। দেশের সব ধর্মের প্রান্তিক দরিদ্র ও সংকটে পড়া মানুষদের সুদমুক্ত ঋণসহ বহুমুখী সেবা দিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। আদায়কৃত কিস্তির টাকা আবার অন্যদের মাঝে বিতরণ করা হয়। এখানে শতভাগ মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করেন। মসজিদগুলোতে ব্রাঞ্চ খুলে লোকাল ম্যানেজমেন্ট টিমের মাধ্যমে কার্য পরিচালনা করার ফলে কোনো ধরনের পরিচালন ব্যয়ও নেই এখানে। এ ছাড়া ওপেন বুক সফটওয়্যারের মাধ্যমে সব কার্যক্রম পরিচালনা করায় সব তথ্য উন্মুক্ত!
ক্ষুদ্র পরিসরে বেসরকারি উদ্যোগে যদি সুদমুক্ত ঋণ চালু করা যায়, তাহলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কাজটা করা আরও সহজ। আর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এটি করা একেবারেই সহজ বলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। নোবেলবিজয়ী ড. ইউনূস ক্ষুদ্রঋণের জন্যই বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব। তিনি বাংলাদেশের সম্মান ও পরিচিতি বাড়িয়েছেন। তার এই বিশাল কর্মের জন্য তিনি সারা পৃথিবীতে সমাদৃত। সারা বিশ্ব ড. ইউনূসের মডেল গ্রহণ করেছে। এই মুহূর্তে ক্ষুদ্রঋণ সহজলভ্য করে দেওয়ার মাধ্যমে বন্যাদুর্গতদের পুনর্বাসনে অত্যন্ত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন তিনি।
অনেকেই বলবেন, ভঙ্গুর অর্থনীতির এ সময় বিনা সুদে কোনো ব্যাংক বা প্রতিষ্ঠান কী অর্থ বিনিয়োগ করবে? আর এই অর্থই বা জোগাড় হবে কীভাবে? উত্তর হলো অর্থ জোগাড় করাও সহজ। এ জন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে একটি পয়সা ছাড়াই এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা সম্ভব। সাম্প্রতিক বন্যার শুরুতে আমরা দেখলাম বহু মানুষ এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের উদ্যোগে ত্রাণ সংগ্রহের বিশাল কর্মযজ্ঞ দেখেছি। আসসুন্নাহ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও প্রতিষ্ঠাতা শায়েখ আহমাদুল্লাহর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ত্রাণ তহবিলে ১০০ কোটি টাকারও বেশি অর্থ জমা দিয়েছেন বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। প্রধান উপদেষ্টার ডাকে সাড়া দিয়ে ইতিমধ্যে তার রাষ্ট্রীয় ত্রাণ তহবিলে দেশ-বিদেশের অনেকেই অনুদান দিয়েছেন। এখন দুর্গতদের পুনর্বাসনের জন্যও আহ্বান জানাতে পারেন তিনি। এসব অর্থ সুদমুক্ত ঋণ হিসেবে বিতরণ করার ঘোষণা দিলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করা যাবে।
প্রাথমিক অবস্থায় বন্যাদুর্গত প্রান্তিক ২ লাখ পরিবারের জন্য গড়ে ১০ হাজার টাকা করে সুদমুক্ত ঋণ দিতে দরকার মাত্র ২০০ কোটি টাকা। ৩ লাখ পরিবারকে দিতে লাগবে মাত্র ৩০০ কোটি টাকা। চক্রাকারে এই ঋণ প্রদান করা হবে। ঋণগ্রহীতাদের কাছে কিস্তি আদায়ের পর সেটা নতুন ঋণগ্রহীতাকে প্রদান করা হবে অর্থাৎ তহবিলের পরিমাণ ‘ফিক্সড’ থাকলেও তা দিয়ে বহু সংখ্যক মানুষকে কয়েকগুণ ঋণ দেওয়া যাবে পর্যায়ক্রমে। এতে একটি স্থায়ী তহবিলও তৈরি হয়ে যাবে।
আর্থিক সংকটে কৃষক জমিতে হাল দিতে পারছেন না, বীজ কিনতে পারছেন না, সার কিনতে পারছেন না, সেচ দিতে পারছেন না। সামান্য পুঁজির জন্য তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারছেন না তারা অতি সহজে সুদমুক্ত ঋণ নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন। এই কার্যক্রমে গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাকের মতো এনজিও প্রতিষ্ঠানসহ অনেকেই এগিয়ে আসতে পারে। সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোও ভূমিকা রাখতে পারে। ব্যাংকগুলো তাদের সামাজিক কাজের অংশ হিসেবে এটা করতে পারেন। ২০০/৩০০ কোটি টাকা দেওয়া ব্যাংকগুলোর জন্য খুব বেশি কঠিন কাজ নয়। ব্যাংকগুলো তাদের প্রচারণার অংশ হিসেবে সামাজিক দায়বদ্ধতার তহবিল থেকেই বিপুল পরিমাণ অর্থ দিতে পারে।
নির্দিষ্ট মেয়াদে এসব ঋণ দেওয়া যেতে পারে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কেউ ঋণের কিস্তি শোধ দিতে না পারলে তাকে জরিমানার বিধান থাকতে পারে। এই জরিমানার অর্থ দিয়ে কল্যাণ তহবিল গঠন করে তা দিয়ে আবার মানুষের সেবা করার সুযোগ রয়েছে। বন্যায় সব হারানো কৃষকের জন্য ঋণের সুদ আরেকটি বোঝা হয়ে উঠতে পারে। কারণ দুবেলা খাবার জোটাতেই যেখানে তাদের অনেকেই হিমশিম খাচ্ছেন সেখানে বাড়তি টাকা তাদের জন্য অসহনীয় হয়ে পড়বে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেড় দশকের বেশি সময় ধরে চলা স্বৈরশাসনের অবসানের পর বাংলাদেশ বৈষম্যহীন নতুন দিনের স্বপ্ন দেখছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দেশবাসীর প্রত্যাশা অনেক।
লেখক : সামাজিক উদ্যোক্তা
এনই