কোটা প্রথা: সুবিধা না অবিচার?
Published : ২১:৪০, ১৭ জুলাই ২০২৪
বাংলাদেশে কোটা প্রথা নিয়ে বিতর্কের সুর আজও তীব্র। সামাজিক সাম্যের লক্ষ্যে প্রবর্তিত এই ব্যবস্থা একদিকে সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য আশীর্বাদ হলেও অন্যদিকে বিতর্ক ও সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। আজ আমরা জানবো এই প্রথার ইতিহাস, প্রবর্তনের প্রেক্ষাপট এবং বর্তমান প্রভাব সম্পর্কে।
কোটা প্রথার উৎপত্তি: বিশ্ব পরিপ্রেক্ষিত
কোটা প্রথার মূল ধারণাটি প্রথম শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনামলে। ভারতে ১৯৩০-এর দশকে প্রথম অনগ্রসর সম্প্রদায়ের জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা নির্ধারণ করা হয়। এই ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য ছিল সমাজের পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীগুলোকে মূলধারায় আনা এবং তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটানো।
কোটা প্রথার প্রবর্তন হয় ১৯৭২ সালে, মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের উদ্দেশ্যে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই প্রথা চালু করেন। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তান শাসনামলে বাঙালিদের প্রতি বৈষম্য পূরণ করা এবং মুক্তিযোদ্ধা, ক্ষতিগ্রস্ত নারী এবং অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সাহায্য করা
বাংলাদেশে কোটা প্রথার প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল
মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের পরিবারের পুনর্বাসন।
অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন।
নারীদের শিক্ষাক্ষেত্রে এবং চাকরিক্ষেত্রে অংশগ্রহণ বাড়ানো।
বাংলাদেশে কোটা প্রথা একটি অত্যন্ত বিতর্কিত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ব্যবস্থা। বর্তমানে বিভিন্ন বিভাগে কোটা বরাদ্দ রয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ, নারী কোটা ১০ শতাংশ, জেলা কোটা ১০ শতাংশ, জাতিগত সংখ্যালঘু কোটা ৫ শতাংশ, এবং প্রতিবন্ধী কোটা ১ শতাংশ। এই কোটা ব্যবস্থা মূলত সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন এবং মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের পুনর্বাসনের উদ্দেশ্যে প্রবর্তিত হয়েছে।
কোটা প্রথার কারণে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীগুলো শিক্ষা এবং চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছে, যা তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটিয়েছে। নারী কোটার ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে এবং কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা নারীর ক্ষমতায়নকে আরো সুদৃঢ় করেছে। মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা কোটা সুবিধার মাধ্যমে উন্নত জীবনযাপনের সুযোগ পেয়েছেন, যা তাদের পুনর্বাসনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।
তবে, কোটা প্রথার কিছু নেতিবাচক প্রভাবও রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে কোটা প্রথা বিতর্কিত হয়েছে কারণ এটি মেধার ভিত্তিতে নয় বরং আর্থ-সামাজিক অবস্থানের ভিত্তিতে সুবিধা প্রদান করে, যা অনেকের কাছে অবিচার ও বৈষম্য বলে প্রতীয়মান হয়েছে। মেধাবী শিক্ষার্থীরা অনেক সময় কোটা সুবিধার কারণে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে পারে, যা তাদের মানসিক চাপের কারণ হতে পারে। এছাড়া, কোটা প্রথার সুযোগ নিয়ে অনেক সময় কিছু মানুষ অনৈতিক সুবিধা নিতে পারে, যা মূলত প্রকৃত সুবিধাভোগীদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
বর্তমানে বাংলাদেশে কোটা প্রথার সংস্কারের দাবি উঠেছে। বিশেষ করে ২০১৮ সালে ছাত্রদের আন্দোলনের মাধ্যমে এই বিষয়টি সরকারের নজরে আসে। সরকার বিভিন্ন সময়ে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা প্রচলিত ছিল। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা, ১০ শতাংশ নারী কোটা, অনগ্রসর জেলার বাসিন্দাদের জন্য ১০ শতাংশ কোটা, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের জন্য ৫ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ শতাংশ আসন সংরক্ষিত ছিল।
ওই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোটা সংস্কারের দাবিতে বড় বিক্ষোভ হয়। কোটাব্যবস্থার সংস্কার করে ৫৬ শতাংশ কোটা থেকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার দাবি জানিয়েছিলেন আন্দোলনকারীরা। পরে সে বছরের ৪ অক্টোবর কোটাপদ্ধতি বাতিলবিষয়ক পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
এর মাধ্যমে ৪৬ বছর ধরে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে যে কোটাব্যবস্থা ছিল, তা বাতিল হয়ে যায়। পরে ২০২১ সালে সেই পরিপত্রের মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের অংশটিকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান উচ্চ আদালতে রিট করেন। সেই রিটের রায়ে চলতি বছরের ৫ জুন পরিপত্রের ওই অংশ অবৈধ ঘোষণা করা হয়। এরপর চাকরিপ্রত্যাশী সাধারণ শিক্ষার্থীরা মাঠে নামেন।
টানা কয়েকদিন আন্দোলনের পর গত ৯ জুলাই কোটা পুনর্বহাল নিয়ে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী। পরেরদিন হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের ওপর এক মাসের স্থিতাবস্থা জারি করেন আপিল বিভাগ। এ আদেশের ফলে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালে সরকারের জারি করা পরিপত্র বহাল থাকছে। তবে শিক্ষার্থীরা আপিল বিভাগের এই আদেশ প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
বিডি/এম