খেলায় কথা রাখছেন মেয়েরা, কর্তৃপক্ষের কী অবস্থা

খেলায় কথা রাখছেন মেয়েরা, কর্তৃপক্ষের কী অবস্থা

হোসাইন নূর

Published : ২২:০১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪

বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের নারীরা। প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে নেই দেশের ক্রিড়াঙ্গনের সঙ্গে জড়িত মেয়েরা। প্রতিনিয়ত দেশকে কথা দিচ্ছেন জয়ের গল্প লেখার এবং কথা রাখতে যোগ্যতার আলোকে ছিনিয়ে আনছেন বিজয়। বলছিলাম দেশের নারী ক্রিকেট ও ফুটবল দলের কথা স্বপ্নজয়ের কাহিনী। কিন্তু দেশের ক্রিড়াঙ্গন কর্তৃপক্ষের কী অবস্থা, তারা কী কথা রাখতে পারছেন।

বাংলাদেশ নারী ক্রিকেটদল নিগার সুলতানা জ্যোতির নেতৃত্বে আজ (৩০ নভেম্বর) ঘরের মাটিতে আয়ারল্যান্ডকে টানা ২ ম্যাচ পরাজিত করে এক ম্যাচ বাকি রেখেই তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ জিতে নিয়েছে। আজকের ৫ উইকেটের জয়ের মাধ্যমে আইসিসি ওয়ানডে বিশ্বকাপে সরাসরি খেলার দৌড়ে ৪ পয়েন্ট বাড়িয়ে নিলেন জ্যোতিরা।

আমরাই ফেভারিট, আমরাই জিতবো

চলমান সিরিজ শুরুর আগে গত মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) টাইগ্রেস অধিনায়ক নিগার সুলতানা জ্যোতি বলেন, যেহেতু ঘরের মাঠে খেলা, আমরাই ফেভারিট, আমরাই জিতবো। সাম্প্রতিক সময়ের সিরিজগুলো যদি দেখেন, অস্ট্রেলিয়া ছাড়া আমরা ভালোই খেলেছি। আমাদের ৬ পয়েন্ট নিতে হবে, খুব গুরুত্বপূর্ণ সিরিজ। প্রতিটা ম্যাচ মূল্যবান। আমরা চেষ্টা করবো দাপট দেখিয়ে খেলতে। যদি দাপট দেখিয়ে খেলতে না পারি, তাহলে বড় দলগুলোর বিপক্ষে কীভাবে চোখে চোখ রেখে লড়াই করবো।

সিরিজ জিতে কথা রেখেছে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেটদল। পাশাপাশি আগামী বিশ্বকাপে সরাসরি খেলার যোগ্যতা অর্জনে আরও এগিয়ে গেলেন জ্যোতিরা।

অন্যদিকে, গত একমাস আগে ৩০ অক্টোবর নেপালের দশরথ রঙ্গশালাতে স্বাগতিকদের বিপক্ষে সাবিনা খাতুনের নেতৃত্বে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল টানা দ্বিতীয়বারের মতো সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জয় করেন।

নিজের সর্বোচ্চটা দেওয়ার চেষ্টা থাকবে, জয়ই আসলে শেষ কথা

গত ১৭ অক্টোবর সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের উদ্দেশে দেশ ছাড়ার আগে বাংলার বাঘিনীদের অধিনায়ক সাবিনা খাতুন বলেন, আমার প্রথম কাজটাই হবে দলকে সাহায্য করা। যাতে প্রতিটি ম্যাচে সবাই ভালো পারফর্ম করতে পারে, সে জন্য ব্যক্তিগতভাবে যতটুকু দেওয়া দরকার, আমি চেষ্টা করবো। একজন অধিনায়ক হিসাবে দলকে মানসিকভাবে চাঙা রাখার কাজটাও আমাকে করতে হয়। এবারও সেই দিকগুলোতে নজর থাকবে। পাশাপাশি প্রতিটি ম্যাচেই বাংলাদেশকে জেতানোর জন্য নিজের সর্বোচ্চটা দেওয়ার চেষ্টা থাকবে। জয়ই আসলে শেষ কথা।

অবশেষে কথা রেখেছেন সাবিনারা। নেপালের দশরথ রঙ্গশালা থেকে শিরোপা ছিনিয়ে বাংলার মাটিতে নিয়ে এসেছেন। একইভাবে ২০২২ সালেও সাফের শিরোপা জিতেছিলেন।

দেশের ক্রিড়াঙ্গনের কথা আসলেই চলে আসে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। ফুটবল ও ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা দুটিকে নিয়মিত জয় এনে দিচ্ছেন মেয়েরা। কিন্তু মেয়েদের বেতন-বোনাস ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা নিয়ে থাকছে আলোচনা-সমালোচনা। মেয়েদের বকেয়া যেনো পিছুই ছাড়ছে না।

সাফ চ্যাম্পিয়নদের বেতন, বোনাস, ম্যাচ ফি সবই বকেয়া!

টানা দ্বিতীয়বার সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপ জয় করেও সাবিনা খাতুনরা অবহেলিত-ই রয়ে গেলেন। সাফে চার ম্যাচ খেলে যে ম্যাচ ফি পাওয়ার কথা সেটা এখনও তাদের বুঝিয়ে দেয়নি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)।

সেপ্টেম্বর মাসের বেতনেরও দেখা নেই। আর সাফ জয়ের পর যে দেড় কোটি টাকা বোনাসের ঘোষণা দিয়েছে বাফুফে, সেটা এখনও দূর আকাশের চাঁদ।

বাফুফেতে নতুন যুগের পত্তন হয়েছে। কাজী সালাউদ্দিনের কাছ থেকে বাফুফের শীর্ষ কর্তার ব্যাটন হাতে পেয়েছেন তাবিথ আউয়াল। কিন্তু খেলোয়াড়দের পাওনা বাকি রাখা যে বাফুফের ‘সংস্কৃতি’র অংশ হয়ে গেছে।

এমনকই বাফুফের কাছ থেকে খেলোয়াড়দের পাওনা নিয়ে গণমাধ্যমে বিভ্রান্তিকর তথ্য দেওয়ার অপচেষ্টাও লক্ষ্য করা গেছে। এই যেমন নারী ফুটবলারদের গত সেপ্টেম্বর মাসের বেতন এখনও বকেয়া। অথচ বাফুফের নারী উইংয়ের প্রধান সমালোচনার মুখে দাবি করেছিলেন শুধু অক্টোবরের বেতন এখনও দেওয়া হয়নি।

কিন্তু খোদ নারী ফুটবলাররা এবং বাফুফের দায়িত্বশীল বিভাগ বলছে, এখনো সেপ্টেম্বরের বেতন হয়নি। এছাড়া সাফের চার ম্যাচের ফি’র পাশাপাশি গত জুন-জুলাই উইন্ডোতে খেলা চার ম্যাচের ফি’ও বকেয়া।

বাফুফের আর্থিক দৈন্যতার কথা কমবেশি সবার জানা। কাজী সালাউদ্দিন বরাবরই বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে কথা বলতেন। বিত্তবানদের কাছে ফুটবলারদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাতে দেখা যায় নারী উইংয়ের প্রধান মাহফুজা আক্তার কিরণকে। সে আহ্বানে সাড়া দিয়ে অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাফজয়ী ফুটবলারদের পুরস্কৃত করেছে। কিন্তু বাফুফে যে নিজেদের প্রতিশ্রুতিও রক্ষা করতে পারছে না।

সাফ চ্যাম্পিয়ন ফুটবলাররা এখন ছুটিতে আছেন। ছুটিতে যাওয়ার আগে বাফুফের কাছ থেকে কিছুই পাননি তারা। শোনা যায়, দ্রুতই খেলোয়াড়দের ছুটি থেকে ফেরানোর পরিকল্পনা নেই, কারণ ক্যাম্পে ফিরলেই ফেডারেশনের ঘোষণাকৃত দেড় কোটি টাকা বোনাসের চাপ বাড়বে।

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের মতো বকেয়ার সংস্কৃতিতেই জড়িয়ে আছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের নাম।

বাফুফে-বিসিবির মতো দেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরাও যেনো নারী খেলোয়াড়দের সমস্যা সমাধান ও সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রে ধীরে চলো নীতিকেই অনুসরণ করছেন।

প্রতিশ্রুতি দেওয়া বাড়ি ও সড়ক না করায় আক্ষেপ

এদিকে গত ২৩ নভেম্বর সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়ন দলের তিন পাহাড়ি কন্যাকে রাঙামাটিতে রাজকীয় সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এ সংবর্ধনায় সিক্ত হন রূপনা চাকমা, ঋতুপর্ণা চাকমা ও মনিকা চাকমা। এদিন দুপুরে রাঙামাটি মারি স্টেডিয়ামে রাঙামাটি রিজিয়ন, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সহযোগিতায় এ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে রাঙামাটি জেলা প্রশাসন।

সাফ সেরা ফুটবলার ঋতুপর্ণা চাকমার বাড়ি কাউখালি উপজেলায়, সেরা গোলরক্ষক রুপনা চাকমার বাড়ি নানিয়ারচরে। মনিকা চাকমার বাড়ি খাগড়াছড়ির লক্ষিছড়িতে হলেও লেখাপড়া ও খেলাধুলা করেছেন ঘাগড়া উচ্চবিদ্যালয়ে। আর এই তিন খেলোয়াড়েরই দাবি ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয়কে সরকারিকরণের।

এদের অর্জন শুধু রাঙামাটি নয় দেশের অর্জন। তাই এমন অর্জনে গর্বিত রাঙামাটি আগামীতেও এ অর্জন ধারাবাহিকভাবে চলমান থাকবে- তেমনটাই প্রত্যাশা ক্রীড়া সংগঠকদের।

ঘাগড়া বিদ্যালয়কে সরকারিকরণের দাবি তিন খেলোয়াড়ের। তবে আগেরবারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া বাড়ি ও সড়ক না করায় কিছুটা আক্ষেপ জানালেন ঋতুপর্ণা চাকমা। নিজ বাড়িতে সেতু নির্মাণের দাবি রুপনা চাকমার। অন্যদিকে মনিকা চাকমার দাবি তার বাড়িতে বিদ্যুৎ ও সড়ক নির্মাণের।

রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন খান জানান, ফুটবলারদের সব সমস্যার সমাধানে প্রশাসন কাজ করবে এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষকেও জানানো হবে।

উল্লেখ্য, ‘বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ফুটবল দল’ হলো আন্তর্জাতিক ফুটবলে প্রতিনিধিত্ব করা বাংলাদেশের জাতীয় মহিলা ফুটবল দল। এটি মহিলা ফুটবল কমিটির তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। দলটি এশীয় ফুটবল কনফেডারেশনের সদস্য এবং দলটি এখনো বিশ্বকাপ বা এএফসি মহিলা এশীয় কাপের ফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি।

২৯শে জানুয়ারি ২০১০ সালে দলটি সর্বপ্রথম নেপালের বিপক্ষে ম্যাচ খেলার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ফুটবলে প্রবেশ করে।

প্রথমবারের মতো দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলের শিরোপা হিসেবে ২০২২ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ট্রফি জয়ী বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ফুটবল দল। ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২ তারিখের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালে স্বাগতিক নেপালকে ৩-১ গোলে হারায় বাংলাদেশ। সর্বশেষ, ৩১ অক্টোবর, ২০২৪ তারিখের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালে স্বাগতিক নেপালকে ২-১ গোলে হারায় বাংলাদেশ।

অন্যদিকে, ‘বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ক্রিকেট দল’ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অঙ্গনে জাতীয় মহিলা ক্রিকেট দল হিসাবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছে। জুলাই, ২০০৭ সালে থাইল্যান্ডের বিপক্ষে দলটি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে। এতে বাংলাদেশ প্রতিপক্ষ দলের বিপক্ষে দু’টি খেলায় অংশগ্রহণ করে বিজয়ী হয়েছিল। এরপর দলটি ২০০৭ সালের এসিসি মহিলাদের প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় ও শিরোপা জয় করে। ২০১১ সালের মহিলাদের ক্রিকেট বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের প্রতিযোগিতায় ৫ম স্থান অধিকার করে। এরফলে বাংলাদেশ দল নেদারল্যান্ডসের পরিবর্তে একদিনের আন্তর্জাতিকে খেলার মর্যাদা লাভ করে।

বিডি/এন

শেয়ার করুনঃ
Advertisement