মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত মূল্যবোধ রক্ষা করতে হবে

মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত মূল্যবোধ রক্ষা করতে হবে

হোসাইন নূর

Published : ০২:১৬, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪

আজ ১৬ ডিসেম্বর,মহান বিজয় দিবস। বাঙালি জাতির গৌরবের দিন, পরাধীনতার শেকল ভেঙে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ শেষে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আত্মসমর্পণ করেছিলো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে পাকিস্তানি শোষকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ১৯৭১ সালের এই দিনে বিশ্বের বুকে লাল সবুজের পতাকা হাতে মুক্তভাবে দাঁড়িয়েছিলো বাঙালি জাতি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ ও পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।

গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহিদদের এবং সেসব মা-বোনদের যারা নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন।

আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ নামক ভূ-খণ্ডটি একদিনে আসেনি বা একদিনের ফসল নয়। সকল অন্যায় অত্যাচার অনাচার, বৈষম্য ও নির্যাতনের বেড়াজাল ছিন্ন করে; শাসক গোষ্ঠির রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ক্ষমতাসীনদের দম্ভ আর অহংকারের মসনদকে চূর্ণ করে ছিনিয়ে আনতে হয়েছে লাল সবুজের পতাকা। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা। এ দেশের মানুষের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার তথা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের নেপথ্যে ছিলো কিংবদন্তি বলিষ্ঠ এক কণ্ঠস্বর, কালো পেশীশক্তি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রত্যয়ে মাথা না নোয়ানো এক তর্জনি; সাথে ছিলো সুশৃঙ্খলিত অসাম্প্রদায়িক ও সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ বাঙালি জাতি। দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের সফলতার ফসল দ্রুত ঘরে তুলতে বাঙালি জাতিকে অনুসরণ করতে হয়েছে পরিকল্পিত পরিকল্পনা, নিয়মনীতি মেনে চলার দৃঢ় মানসিকতা ও অসীম সাহসীকতার সাথে লেগে থাকার ধৈর্য।

সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিকভাবে সূচনা হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরুর পর ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু মাতৃভূমিকে মুক্ত করার ডাক দিয়েছিলেন। আহ্বান জানিয়েছিলেন শত্রুহায়েনাদের বিতাড়িত করতে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করার।

বঙ্গবন্ধুর সেই বার্তা তৎকালীন ইপিআরের ওয়্যারলেস থেকে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণায় সেদিনই সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতি। চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ।

২৬ মার্চ দুপুরে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল হান্নান প্রথমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজবুর রহমানের ঘোষণা পাঠ করেন। ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমান জাতির পিতার পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।

বিশ্বের একটি সুশৃঙ্খল ও অত্যাধুনিক সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালিদের রুখে দাঁড়ানোর নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার নিভৃত আমবাগানে শপথ নেয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, তার অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে এই সরকারের নেতৃত্বেই মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিক কাঠামো লাভ করে।

দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী প্রাণপণ যুদ্ধের সফল পরিণতিতে বিশ্ব মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলার আকাশে ওড়ে বিজয়ের লাল-সবুজ পতাকা। মরণপণ লড়াই ও একসাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় এই বিজয়। স্বাধীনতা তাই বাংলাদেশিদের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন।

বাংলাদেশ আজ ৫৩তম পেরিয়ে ৫৪তম বিজয় দিবসে দাঁড়িয়ে। বৈশ্বিক বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বিশ্ব দরবারে মাথা উচু করে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে বাঙালি জাতি। স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত জাতির পিছুটান বলতে কিছু নেই, নতুন করে নেই হারানোর কিছু। তবু অজানা শঙ্কা দানা বাঁধছে মনে-ভিনদেশী শত্রুর আক্রমনে দেশ হারানোর ভয় নেই বা ভূ-খন্ড হারানোর ভয় নেই, তাই বলে পেশীশক্তির গরমে বা ক্ষমতার দাপটে কিংবা সামাজিক প্রভাবের কারণে যা ইচ্ছে তাই করতে হবে বা চলতে হবে; যদি তাই হয়, তবে এই স্বাধীনতার স্থায়িত্ব ও স্থিতিশীলতা ভোরের দেখা স্বপ্নের মতো মিলিয়ে যেতে বাধ্য হবে।

১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই জীবনের সর্বক্ষেত্রে বাঙালি জাতি উপেক্ষিত, বঞ্চিত ও শোষনের শিকার হতে শুরু করে। ফলশ্রুতিতে বাঙালিস্বত্বার মধ্যে দানা বেঁধে বিস্ফোরিত হয় বেশ কিছু আন্দোলন- রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন, জনসংখ্যাভিত্তিক আইন পরিষদ গঠনের দাবীতে আন্দোলন এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের দাবীতে সংগ্রাম।

মূলত ভাষা আন্দোলনের প্রভাবই ছিল মুখ্য যার ফলশ্রুতিতে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে দীর্ঘমেয়াদী সংগ্রামে রুপ দান করে।

পূর্ব পাকিস্তান রাষ্ট্র সমাজ, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ভৌগলিক অবস্থানের সকল বিরুদ্ধতাকে উপেক্ষা করে প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রকৃতপক্ষে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে একমাত্র ধর্ম ব্যতীত কোন সাদৃশ্য ছিলনা। মূলতঃ প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণে দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে।

আজ ২০২৪ সাল ১৬ ডিসেম্বর। ৫৪তম বিজয় দিবসে দাঁড়িয়ে সংবাদ পত্রের পাতায় চোখ বুলালে দেখা যায় উন্নতি আর সফলতায় বিস্ফোরিত জাতির পরতে পরতে দুর্নীতির বিষফোড়া আর বৈষম্য। যা এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে বিশ্ব দরবারে ম্লান করায় মত্ত।

মহান স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেলেও তা বারবার হোঁচট খেয়েছে। ফলে আজও প্রাতিষ্ঠানিক রুপ পায়নি গণতন্ত্র। এর বড় কারণ, রাজনীতিতে অসহিষ্ণুতা ও ঐকমত্যের অভাব। জাতীয় ইস্যুগুলোতে অন্তত  সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে ঐক্য থাকা প্রয়োজন হলেও কোনো শাসনামলেই তা দেখা যায়নি। এক্ষেত্রে দেশের চেয়ে দলের স্বার্থ ও একচোখা নীতিই প্রাধান্য পেয়েছে বারবার।

দেশের রাজনীতি এতটাই কুলষিত যে সহাবস্থান বলতে কিছু নেই, ভিন্ন মতের যৌক্তিকতার প্রতি নেই শ্রদ্ধা, নেই নিজ ব্যক্তি বা দলের সৌন্দর্য দিয়ে কাছে টানার মানসিকতা। পদ আর ক্ষমতার দম্ভে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা বেপরোয়া। নেই সংযম ও ত্যাগের সহাবস্থান।

বাঙালি জাতির সাংস্কৃতিক ইতিহাস ও ঐতিহ্য পশ্চিমা সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে নোংরামীতে ভরে গেছে। ধর্মীয় গোঁড়ামি আর একপেশে নীতি দেশের হাজার বছরের সাংস্কৃতির সম্প্রীতির মধ্যে টেনে দিচ্ছে সাম্প্রদায়িক বিভক্তির স্পষ্ট দেয়াল।

দেশের সর্বত্র আজও প্রকাশ্যে ও গোপনে ছড়িয়ে আছে সামাজিক বৈষম্য। সংবাদ পত্রের পাতা খুললেই ভেসে উঠে ধর্ম-বর্ণ, জাত পাতের ভেদাভেদ বিভৎস চিত্র এবং উপজাতি, আদিবাসী ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের উপর বিভিন্ন নির্যাতন নিগ্রহের খবর। নারী নির্যাতন ও যৌন নিপীড়নের ঘটনা যেন ভাইরাসের মতো ক্রমেই বেড়ে চলছে।

অর্থনৈতিক বৈষম্য স্পষ্টতই প্রকট আকার ধারণ করেছে। বাজার থেকে ব্যাংক, পাড়া থেকে পারলামেন্ট সর্বত্রই দুর্নীতি, অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারের প্রতিযোগিতায় দেশ আজ ছয়লাব। সংবাদ পত্রের পাতায় চোখ বুলালে মনে হয়, দুর্নীতিই যেন নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বত্র আজ প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য ও অসংগতি চিত্রিত হচ্ছে। পদ-পদবী, ক্ষমতা আর প্রভাবের স্বেচ্ছাচারিতা দেশের স্বাধীনতাকে বারবার আঘাত করছে। তাই সময় থাকতে স্বাধীনতার চেতনায় বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে টিকে থাকতে হলে এখন থেকেই ঘুরে দাড়াতে হবে। না হলে মুক্তির এই স্বাধীনতা স্বপ্নের শো কেসে স্থান নেবে।

সতর্ক থাকতে ও মনে রাখতে হবে, এ দেশের মানুষ সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের অপতৎপরতা, ধর্মের নামে সহিংসতা সমর্থন করে না। মানবাধিকারের প্রশ্নে সরকারকে হতে হবে অঙ্গীকারবদ্ধ। স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে সব বিভেদ ভুলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।

বাংলাদেশের পাঁচদশকের পথচলায় দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষার প্রসার, নারী উন্নয়ন, শিশুমৃত্যুর হার কমানোসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফলতা এসেছে। উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে মাথাপিছু আয়। লালসবুজের বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হতে যাচ্ছে। এ অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হবে।

লেখক: রিপোর্টার, দ্য বিজনেস ডেইলি

বিডি/এন

শেয়ার করুনঃ
Advertisement