প্রকাশিত হচ্ছে কেয়ামতের যেসব আলামত
Published : ২২:৫৬, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪
সম্প্রতি ফোরাত নদীর পানি হ্রাস নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে বিশ্বজুড়ে। অনেকে নদী শাসনের ক্ষেত্রে অবহেলাকে দুষলেও এ বিষয়ে নবী করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভবিষ্যদ্বাণীর ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ তুলে ধরা গুরুত্বপূর্ণ।
আল্লাহ কোরআনে বারবার কেয়ামতের কথা বলে মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, এই পৃথিবী নশ্বর। সবাইকে একদিন মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলার কাছে ফিরতে হবে।
নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হত, কেয়ামত কবে হবে। তার জবাবে আল্লাহ তাআলা ওহি নাজিল করে জানিয়েছেন, কেয়ামত নির্দিষ্ট সময়ে হবে। যার ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা ব্যতীত আর কেউ জানে না। (সুরা হা-মিম-সাজদা ৪৭)
কেয়ামত কখন হবে তা স্পষ্ট করে না জানানো হলেও নবীজি তার উম্মতকে সতর্ক করার জন্য বারবার কেয়ামতের আলামত নিয়ে আলোচনা করেছেন। বর্ণনা করেছেন কেয়ামতের ছোট ও বড় আলামত নিয়ে।
কেয়ামতের ছোট ছোট আলামত কিছু প্রকাশিত হলেও বড় কোনো আলামত এখনো প্রকাশিত হয়নি। তবে বড় আলামত প্রকাশিত হওয়ার আগে যেসব ছোট আলামত প্রকাশিত হবে তার কিছু প্রকাশিত হওয়ার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
ধীরে ধীরে প্রকাশিত হওয়া এসব আলামতের মধ্যে রয়েছে ফুরাত নদী থেকে স্বর্ণের পাহাড় প্রকাশিত হওয়া, আরব ভূখণ্ড সবুজ তৃণলতায় ভরে যাওয়া এবং মদ্যপান, ব্যভিচার ও সুদের প্রচলন বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি।
দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী হলো ফুরাত। এটি তুরস্ক থেকে উৎপন্ন হয়ে সিরিয়া ও ইরাক অতিক্রম করে দজলা নদীর সঙ্গে মিশে পারস্য উপসাগরে পতিত হয়েছে। প্রায় দুই হাজার ৭০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদী তুরস্ক, সিরিয়া, ও ইরাকের জন্য পানির প্রধান উৎস। নদীটি প্রাচীন সভ্যতাগুলোর বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
হজরত আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেন, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, অচিরেই ফোরাত নদী শুকিয়ে যাবে আর এর থেকে স্বর্ণের পাহাড় উন্মোচিত হবে। যে ব্যক্তি সে সময় উপস্থিত থাকবে, সে যেন এর কিছুই গ্রহণ না করে। (বুখারি ৭১১৯)
অন্য আরেকটি হাদিসে এসেছে, কেয়ামত সংঘটিত হবে না যতক্ষণ না ফোরাত নদীতে একটি স্বর্ণের পাহাড় প্রকাশ পাবে। মানুষ তা নিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হবে, এবং প্রতিটি দলের শতকরা নিরানব্বই জন মারা যাবে। তাদের প্রত্যেকেই বলবে, ‘হায়! আমি যদি বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিটি হতাম। (মুসলিম ২৮৯৪)
ইসলামি স্কলারদের মতে, এই হাদিসের ভবিষ্যদ্বাণীকে কয়েকভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। শাইখুল ইসলাম তাকি উসমানি বলেন, ফোরাত নদীর স্বর্ণের পাহাড় দুই অর্থে হতে পারে এক. নদীর স্থানে একটি পাহাড় উঠবে, যেখানে স্বর্ণের খনি থাকবে। দুই. নদীর তলদেশে প্রচুর স্বর্ণের মজুদ উন্মোচিত হবে (তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম ১২/২২৮)
সাম্প্রতিক সময় ফোরাত নদীর পানির স্তর উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে, যা তুরস্ক, সিরিয়া ও ইরাকের মধ্যে বাঁধ নির্মাণ ও পানির ব্যবহারের কারণেও হতে পারে। তবে নদীর স্বর্ণের পাহাড় প্রকাশের আলামত এখনো পূর্ণরূপে দেখা যায়নি। স্কলার ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) বলেছেন, এই ঘটনা ইমাম মাহদির আগমনের ঠিক পূর্বে সংঘটিত হবে (ফাতহুল বারি ১৩/৯৬)
নবীজি সল্লাল্লাহু এক হাদিসে কেয়ামতের ছোট ছোট আলামত নিয়ে কথা বলেছেন। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে এমন একটি হাদিস শুনেছি, যা আমি ছাড়া আর কেউ তোমাদের বর্ণনা করবে না। তিনি বলেন,
مِنْ أَشْرَاطِ السَّاعَةِ أَنْ يَظْهَرَ الْجَهْلُ وَيَقِلَّ الْعِلْمُ وَيَظْهَرَ الزِّنَا وَتُشْرَبَ الْخَمْرُ وَيَقِلَّ الرِّجَالُ وَيَكْثُرَ النِّسَاءُ حَتّٰى يَكُونَ لِخَمْسِينَ امْرَأَةً قَيِّمُهُنَّ رَجُلٌ وَاحِدٌ.
অর্থ: কেয়ামতের কতক নিদর্শন হল অজ্ঞতা প্রকাশ পাবে, দীনি ইলম হ্রাস পাবে, ব্যভিচার প্রকাশ হতে থাকবে, মদ্যপান ব্যাপক হবে, পুরুষের সংখ্যা কমবে আর নারীদের সংখ্যা বেড়ে যাবে। এমনকি পঞ্চাশ জন নারীর পরিচালক হবে একজন পুরুষ। (বুখারি ৫৫৭৭)
আরবভূমিতে বিশেষ করে মক্কা ও মদিনায় সবুজ গাছপালা ও তৃণলতা সাধারণত দেখা যায় না। নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى تَعُودَ أَرْضُ الْعَرَبِ مُرُوجًا وَأَنْهَارًا
অর্থাৎ ততদিন পর্যন্ত কেয়ামত প্রতিষ্ঠিত হবে না যতদিন পর্যন্ত না আরব উপদ্বীপ গাছপালা ও নদী-নালায় পূর্ণ হবে (মুসলিম, ইবনে হিব্বান ৬৭০০)
২০২৩ সালে সৌদি আরবে অর্থাৎ মক্কা-মদিনার পাহাড়-পর্বতের অবিশ্বাস্য কিছু ছবি নেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। যেখানে দেখা যায় মক্কা ও মদিনার কিছু অঞ্চল সবুজ ঘাসে ভরে গেছে। সৌদি আরবের ন্যাশনাল সেন্টার অব মেটিওরোলজি (এনসিএম) জানায়, দেশটির বেশির ভাগ অঞ্চলে বৃষ্টি হওয়ার পর এমন হয়েছে। যা আগে কখনো কল্পনাও করা যেত না তা ঘটেছে সৌদিতে।
এছাড়াও আরও কিছু আলামতের কথা হাদিসে উল্লেখ করা আছে যা ধীরে ধীরে প্রকাশিত হচ্ছে।
১. আমানতদারিতা না-থাকা। আমানতদারিতা ক্ষুণ্ন হওয়ার একটা উদাহরণ হচ্ছে- যে ব্যক্তি যে দায়িত্ব পালনের যোগ্য নয় তাকে সে দায়িত্ব প্রদান করা।
২. সুদ ছড়িয়ে পড়া। সারা বিশ্বে এখন সুদের ব্যাপকতা তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। যতটা ব্যাপক ২০ শতকের আগে তেমন একটা ছিল না।
৩. নানারকম গোলযোগ (ফিতনা) সৃষ্টি হওয়া। যেমন ইসলামের শুরুর দিকে উসমান (রা.) এর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়া, জঙ্গে জামাল ও সিফফিন এর যুদ্ধ, খারেজিদের আবির্ভাব, হাররার যুদ্ধ, কুরআন আল্লাহর একটি সৃষ্টি এই মতবাদের বহিঃপ্রকাশ ইত্যাদি। বর্তমানেও ইসলামি বিভিন্ন দল ও বাহিনীর আবির্ভাব ঘটছে। এসব দল ও বাহিনীর মধ্যে অন্তর কোন্দল দেখা যাচ্ছে। যা দিন দিন আরও বেশি হবে বলে ইসলামি চিন্তাবিদরা ধারণা করছেন।
৪. নবুয়তের মিথ্যা দাবিদারদের আত্মপ্রকাশ। যেমন মুসাইলামাতুল কাযযাব ও আসওয়াদ আনসির মিথ্যা দাবি। সবশেষ ভারতীয় উপমহাদেশে গোলাম আহমদ কাদিয়ানির মিথ্যা নবুয়্যত দাবি নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। যার রেশ এখনও রয়ে গেছে। ভবিষ্যতে মিথ্যা নবুয়্যত দাবি আরও বেড়ে যাবে। হাদিসে এমনটিই জানা যায়।
৫. মানুষের আকৃতি রূপান্তর, ভূমি ধস ও আকাশ থেকে পাথর পড়া কেয়ামতের ছোট আলামতগুলোর অংশ। বর্তমানে ‘হরমোনাল রিপ্লেসমেন্ট সার্জারি’ করে বিশ্বব্যাপী ছেলে থেকে মেয়ে ও মেয়ে থেকে ছেলে হওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। যা ভবিষ্যতে আরও ব্যাপক হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
৬. কেয়ামতের আগে কাপড় পরিহিতা সত্ত্বেও উলঙ্গ এমন নারীদের বহিঃপ্রকাশ ঘটবে বলে হাদিসে বলা আছে। বর্তমান যুগে নারীদের পোশাকে এমন বৈচিত্র্য দেখা যাচ্ছে যা এই হাদিসকে সত্যায়িত করছে। কেয়ামতের আগে এর ব্যাপকতা বেড়ে যাবে তা নিয়ে সহজেই অনুমান করা যায়।
লেখক: মাওলানা নোমান বিল্লাহ
বিডি/ও