শিক্ষার আলো ছড়ানো নিবেদিত প্রাণ, গুণী মানুষ নুরুদ্দিন আহমেদ
Published : ২০:৫৬, ১৭ আগস্ট ২০২৪
পৃথিবীর ইতিহাসে যুগে যুগে অনেক জ্ঞানীগুণী সমাজসেবক, শিক্ষানুরাগী মহৎপ্রাণ আলোকিত মানুষ জন্মগ্রহণ করেছেন। আলোকিত মানুষ বলতে তাদেরই বুঝি যাদের জ্ঞানের আলোয় সমাজ হয় আলোকিত।
যাদের কল্যাণকর চিন্তার বাস্তবায়নে সমাজের উন্নয়ন হচ্ছে, যাদের জ্ঞানের পরশে মানুষের চিন্তাধারার পরিবর্তন আসছে, দক্ষ জনসম্পদ গড়ে উঠছে। এ কথা সবারই জানা, আলোকিত মানুষ তৈরির জন্য সুশিক্ষার যেমন প্রয়োজন, আদর্শ শিক্ষকেরও তেমন প্রয়োজন।
তেমনি একজন আলোকিত গুণী শিক্ষক নুরুদ্দিন আহমেদ। কর্মবীর মানুষটি জীবনের প্রতিটি কাজে রেখেছেন অসাধারণ অবদান। মানুষ যেসব কীর্তিমান সন্তানকে নিয়ে গর্ব করতে পারে, তিনি তাদের মধ্যে একজন।
জীবনের প্রথম দিন থেকেই তিনি সমাজের নিরক্ষর মানুষগুলোকে কিভাবে শিক্ষিত করা যায় সে চেষ্টাই শুরু করেন। শিক্ষার আলো ছড়ানো এই ব্যক্তি অনেক উঁচু মাপের একজন আদর্শ শিক্ষাগুরু।
বৈবাহিক জীবনে ৮ ছেলে ২ মেয়ের জনক তিনি। স্ত্রী জুলেখা নুরুদ্দিন মারা গেছে ২০০৩ সালে। তার বড় ছেলে মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ (চুন্নু ) এবং দ্বিতীয় ছেলে আলাউদ্দিন আহমেদ মারা গেছেন। এছাড়া তার সেজো ছেলে সালাহ উদ্দিন আহমেদ সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা। চতুর্থ ছেলে মেফতাহ্ উদ্দিন আহমেদ প্রবাসে ছিলেন। পঞ্চম ছেলে হাফেজ মাওলানা কামাল উদ্দিন আহমেদ সৌদিতে একটি মসজিদের ইমাম হিসেবে রয়েছেন।
ষষ্ঠ ছেলে শারফুদ্দিন আহমদ মানিকগঞ্জ সহকারী মাধ্যমিক জেলা শিক্ষা অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন। সপ্তম ছেলে বাহাউদ্দিন নাঈম এডভোকেট এবং অষ্টম ছেলে হেলাল উদ্দিন আহমেদ (ফারুক) কর্মরত আছেন হাতিয়াব ইসলামিয়া সিনিয়র মাদ্রাসার সহকারী অধ্যাপক (বাংলা)। এছাড়া দুই মেয়ে রেহেনা সুলতানা স্কুল শিক্ষিকা (অব) এবং ঝর্ণা সুলতানা গৃহিনী।
নুরুদ্দিন আহমেদের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সালনা কাথোরা এলাকায় সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবার মৈশান বাড়ি। ওই বাড়ির মনির উদ্দিন মৈশানের ছেলে আলহাজ্ব নুরুদ্দিন আহমেদ। তিনি তার বাবার দ্বিতীয় সন্তান। নুরুদ্দিন আহমেদের জন্ম ১৯১৮ ইং সালের দিকে।
তিনি ইছরকান্দি উচ্চ বিদ্যালয়, সাভার থেকে ১৯৪৭ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করে ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৪৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এর পর তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন।
তিনি প্রথমে সালনা সরকারী প্রথমিক বিদ্যালয় পরে মারিয়ালি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং কাথোরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষা জীবনের মূল ভিত্তি হলো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা। এখানের শিক্ষা যত দৃঢ় ও আদর্শ এবং নৈতিকতা সংবলিত হয় বাকি জীবনে তার প্রতিচ্ছবি কাজ করে।
শিশু শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে পারলে একদিকে প্রাথমিক শিক্ষা যেমন মজবুত হয় অপরদিকে শিক্ষার হার বেড়ে বেকারত্ব কমার পাশাপাশি আদর্শ সমাজ গঠন করা সম্ভব হয়। একটা সময় দেশের শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষ ছিল অশিক্ষিত। অশিক্ষিত হওয়ায় প্রতিনিয়ত অবহেলা আর বঞ্চনার শিকার হতো হতে।
আর তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থাও ছিলো কুসংস্কারে ভরা। ঠিক ওই সময়ে সমাজের কুসংস্কার দূর করে সকলের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন নুরুরদ্দিন আহমেদ। সে সময় থেকে আজ পর্যন্ত তিনি অসংখ্য স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন।
নুরুদ্দিন আহমেদ তৃতীয় ছেলে সাবেক সেনাবাহীর কর্মকর্তা সালাহ উদ্দিন আহমেদ জানান, তার বাবা সমাজসেবক, অগণিত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের শিক্ষা গুরু, সমাজ সংস্কারক ও বিশিষ্ট ধর্মানুরাগী। তার বাবার নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে গাজীপুরের সালনা নাসির উদ্দিন মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়, সালনা সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসা ছাড়াও নিজেদের জমির উপরে টেক কাথোরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, টেক কাথোরা আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন।
জীবনের শেষ মুহুর্তে এসেও সম্পূর্ণ নিজস্ব জায়গা দান করেছেন একটি হাসপাতাল করার জন্য। যেটি সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে তার মায়ের নামে জুলেখা নুরুদ্দিন নগর স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও হাসপাতাল তৈরী করা হচ্ছে। তার বাবা নুরুদ্দিন আহমেদ এখন পর্যন্ত চশমা ছাড়া কোরআন পড়েন এবং চলাফেরা করেন। দুটি লাঠি ভর করে একাই বাড়ির পাশের মসজিদে গিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন।
তার ষষ্ঠ ছেলে মানিকগঞ্জের সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসার শারফুদ্দিন আহমদ বলেন, আমার বাবা একজন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তিনি তার সামান্য আয় দিয়ে আমাদের পরিবারের ৮ ভাই ও ২ বোনকে ইহলৌকিক জ্ঞান ও পরলৌকিক জ্ঞানের মাধ্যমে আমাদের গড়ে তুলেছেন। আমার বাবার ছাত্র এম.পি, মন্ত্রী, চেয়ারম্যান ও সরকারি বড় বড় কর্মকর্তা থাকা সত্ত্বেও নিজের জন্য ও পরিবারের জন্য তেমন কোন কিছু করেননি।
বাবা একদিকে যেমন আদর্শ বাবা, আদর্শ শিক্ষক অন্যদিকে আদর্শ সমাজসেবক। বর্তমানে বাবা প্রায় ১১০ বছর বয়সে অল্লাহর ইচ্ছায় ও সকলের ভালোবাসা ও দোয়ায় সুস্থ শরীরে বেঁচে আছেন। তিনি এখনো পায়ে হেঁটে মসজিদে যেতে পারেন।
নুরুদ্দিন আহমেদ জানান, তিনটি রাষ্ট্র শাসন আমল দেখেছেন তিনি ব্রিটিশ, পাকিস্তান এবং বর্তমান বাংলাদেশ। এছাড়া ভাওয়াল রাজা রমেন্দ্র নারায়ণ রায়কে তিনি দেখছেন। ৫-৬ মাইল পায়ে হেটে ভাওয়াল রানীর প্রতিষ্ঠিত রানী বিলাস মনি স্কুলে তিনি লেখা পড়া করেছেন। যখন মাধ্যমকি পরীক্ষা দেন তখন তিনি দুই ছেলের বাবা।
কলেজ জীবনের বন্ধু ছিলেন সাবেক রাষ্টপতি জিল্লুর রহমান। এছাড়া তার ছাত্র সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক এমএ মান্নান, সোনালী ব্যাংকের জিডিএম ফাইজুদ্দিন আহমেদ, অগ্রণী ব্যাংকের জিএম আব্দুল মোতালিব, মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ ১৯ মার্চে প্রধান সমন্বয়ক হাবিুবল্লা। ব্রিটিশ কিংবা পাকিস্তানের সময়ে যারা সংসদ সদস্য বা স্থানীয় চেয়ারম্যান ছিলেন, তাদের সঙ্গে তার ছিল বেশ সক্ষতা। সে সুবাদেই তিনি বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নিয়ে সবার সহযোগীতায় সফল হয়েছেন।
জীবনের এই শেষ মুহুর্তের এসেও স্বপ্ন দেখছেন তার নিজ বাড়িতে একটি হাফেজি মাদ্রাসা ও এতিম খানা তৈরী করার। তিনি চান যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন সে গুলো যেন সুন্দর ভাবে পরিচলানা করা হয় এবং সকল শ্রেণি পেশার মানুষের সন্তানেরা যেন শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায়। কাথোরা এলাকাসহ আসপাশের মানুষের কষ্ঠ লাগবে সম্প্রতি যে জমিটুকু তিনি হাসপাতাল করার জন্য দান করেছেন তাও যেন সঠিক ভাবে পরিচলনা করা হয়।
বিডি/এন