অপরূপ সৌন্দর্যে ঘেরা মহেড়া জমিদার বাড়ী

অপরূপ সৌন্দর্যে ঘেরা মহেড়া জমিদার বাড়ী

খন্দকার আশরাফুল ইসলাম

Published : ১৯:৫৩, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

প্রকৃতির অনিন্দ্য আলয় মহেড়া জমিদার বাড়ি অপরূপ সৌন্দর্যে ভরপুর। কালের নিদর্শন হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে এক উজ্জ্বল ভাস্কর্য। নিভৃত পল্লীতে, পাখী ডাকা নির্ঝর নির্মল শান্ত পরিবেশ আকুল করবে ভ্রমণপিপাসুদের। আগন্তুককে বারবার হাতছানি দিয়ে আমন্ত্রণ জানায় দেশী-বিদেশী ফুলের সমারোহ ও সুশোভন বাহারী পাতাবাহার দ্বারা পরিবেষ্টিত ফুলের বাগান। গাছে গাছে পাখিদের অবাধ কলকাকলিতে মুখরিত চারপাশ,শান্ত-সৌম্য কোলাহলমুক্ত পরিবেশ আপনাকে দিবে এক অন্যরকম ভ্রমানুভুতি।এক কথায় যেন ধরায় স্বর্গধাম।

বলা হয়ে থাকে স্পেনের করডোভা নগরীর আদলে ভবনসমূহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কালের পরিক্রমায়অনিন্দ্য শোভিত হয়ে সময়ের স্বাক্ষী হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে দৃষ্টিনন্দন এইজমিদার বাড়ী।

দৃষ্টিনন্দন জমিদার বাড়ীটির রয়েছে এক কলঙ্কিত স্মৃতি। ১৪ই মে, ১৯৭১ সাল। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময় হানাদার বাহিনী এই জমিদার বাড়ীতে হামলা করে এবং বাড়ীর কূলবধূ যোগমায়া রায় চৌধুরীসহ আরও পাঁচজন গ্রামবাসীকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়। এরমধ্যে পন্ডিত বিমল কুমার সরকার (স্থানীয় প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক), অতুল চন্দ্র সাহা,মনিন্দ্র কুমার চক্রবর্তীএবং নোয়াই বণিক ছিলেন। কলঙ্কিত সেই রক্তের দাগ এখনো লেগে আছে মহেড়া জমিদার বাড়ীতে। ফলশ্রুতিতে শত বছরের সাজানো জমিদার বাড়ী আর কোটি টাকার সম্পদ ফেলে চরম ঘৃণা আর ক্ষোভ নিয়ে লৌহজং নদীর নৌপথে নৌকা যোগে চলে যান এইদেশ ছেড়ে। অতঃপর স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বায়েজীদ এর নেতৃত্বে জমিদার বাড়ীতে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন করে।

  ১৯৭২ সালের দিকে পরিত্যাক্ত জমিদার বাড়ীটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে পুলিশ ট্রেনিং সেন্ট্রার হিসেবে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।মহতী এই কাজটি করেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আব্দুল মান্নান। আর পুলিশের ট্রেনিং সেন্টার স্থাপন হওয়ায় এর সৌন্দর্য্য শুধু অক্ষতই থাকেনি বরং তার কলেবর আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।

ইতিহাস বলে ১৮৯০ দশকের পূর্বে জমিদার বাড়ীটির পত্তন ঘটে। কালীচরণ সাহা ও আনন্দ সাহা নামে দুই ভাই কলকাতা ছেড়ে চলে আসেন মহেড়া গ্রামে। মহেড়া গ্রামে তারা ১ হাজার ১৭৪ শতাংশ জমির ওপর এ সুবিশাল বাড়িটি নির্মাণ করেন।পরে ব্রিটিশ সরকার জমিদার প্রথা চালু করলে কালীচরণ সাহা ও আনন্দ সাহার ছেলেরা করটিয়া ২৪ পরগনার জমিদারদের কাছে থেকে একটি অংশ বিপুল অর্থের বিনিময়ে কিনে নেয়। শুরু হয় জমিদারি।

রাজেন্দ্র রায় চৌধুরী যিনি ছিলেন কালীচরণ সাহা ও আনন্দ মোহন সাহার পরবর্তী উত্তরাধিকারী। এরপর থেকে তিনি জমিদারি পরিচালনা করেন। এই সময় এলাকায় বিদ্যালয়, রাস্তাঘাট, পানির ব্যবস্থাসহ অনেক জনকল্যাণমূলক কাজ করেন। এখানে আছে বড় বড় ৩টি ভবন আর কাছারি বাড়ী। এই ভবন গুলো এবং কাছারি বাড়ীর নাম যথাক্রমে মহারাজ লজ, চৌধুরী লজ, আনন্দ লজ, এবং কালীচরণ লজ।

আরও আছে আত্মীয় স্বজন কর্মচারীদের থাকার বাড়ী এবং প্রার্থনার জন্য মন্দির। বাড়ির প্রবেশ দ্বারে রয়েছে ২টি সুরম্য ফটক। বাড়ীর সামনেই দেখামিলে বিশাল এক দীঘি নাম তারবিশাখা সাগর। ভবন গুলোর পিছনে রয়েছে পাসরা পুকুর এবং রানী পুকুর নামে দুইটা পুকুর যা এর সৌন্দর্য্যকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। ভবন গুলোর সামনে সুন্দর ফুল শোভিত কানন। ভবন গুলো আর বিশাখা সাগর এর ঠিক মাঝখানে রাস্তার পাশে রয়েছে কয়েকটা উচু গোল কারুকার্যময় স্তম্ভ। রয়েছে কালীচরণ লজ-এর সামনে বেশ বড় একটা খোলা মাঠ।

মহেড়া জমিদারগণের ছিল বিশাল বিশাল স্থাপনা। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিল তাদের বাণিজ্যিক বিস্তার। জমিদারদের সুবিশাল অফিস ব্যবস্থাপনার জন্য ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল নায়েব ভবন, কাছারি ভবন প্রভৃতি। নায়েব ভবন ও কাছারি ভবন গুলো ছিল তিন কক্ষ বিশিষ্ট চমৎকার নির্মাণ শৈলীতে গড়া। অপর গোমস্তা ভবনও সুপ্রাচীন স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত। জমিদারের নায়েব গোমস্তা প্রভৃতি দাপ্তরিক ব্যক্তিবর্গ এসকল ভবনে দাপ্তরিক কর্ম সম্পাদন করতেন। মহেড়া জমিদার বাড়ীটি মূলতঃ চার টি ভবনে বেষ্টিত। যথা- মহারাজ লজ, আনন্দ লজ, চৌধুরী লজ এবং রাণী ভবন(কালীচরণ লজ) নামে পরিচিত।

জমিদার বাড়ীর পূর্বপুরুষেরা হলেন- বিদু সাহা, বুদ্ধু সাহা, হরেন্দ্র সাহা ও কালীচরণ সাহা। জনশ্রুতি রয়েছে, জমিদার তরফের সবচেয়ে পরিচিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন মহারাজ ভবনের গিরেন্দ্র কুমার রায় চৌধুরী। তিনি পশু (বাঘ, হরিণ, ঘোড়া) ও পাখি (ময়ূর, টিয়া, ময়না) সহ বিভিন্ন প্রজাতির পশু-পাখি লালন-পালনকরতেপছন্দ করতেন। কাছারী বাড়ীতে বাঘেরএকটি খাঁচাও ছিল। বাঘটিকে আদর করেডাকতেন ফুলেশ্বরী বলে। তাদের খাবার দাবারের খোঁজ খবর নিজে রাখতেন।

১৮৯০ সাল।মহেড়া আনন্দ উচ্চ বিদ্যালয়টি জমিদার বাড়ীর আনন্দ কুমার রায় চৌধুরীর নামে প্রতিষ্ঠিত হয়। গোপিনাথ জিওর বিগ্রহ মন্দির জমিদারদেরসময়কালে প্রতিষ্ঠিত। পানির অভাব মেটানোর জন্য গ্রামে গ্রামে অনেক কূপ খনন করে দেন জমিদারগণ। মহেড়া থেকে এক কিলোমিটার দূরে ছাওয়ালী বাজারে এক সুবিশাল শ্রী শ্রী শ্মঁশাণ কালী মায়ের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।

বিশাখা সাগর সংলগ্ন দক্ষিণ পার্শ্বে বিশাল আমের বাগান। ফজলি, ল্যাংড়া, গোপালভোগসহ দেশী বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ শোভা পাচ্ছে। আম্র কানন ব্যতীত বর্তমান পিটিসি’র প্রায় ৪৪ একর জমিতে সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা বৈচিত্র্যময় ফলের সমারোহ। এর মধ্যে আম, কাঁঠাল, নারিকেল, ছবেদা, জলপাই, হরিতকি ইত্যাদি ফল ও ঔষধি গাছ অন্যতম।

নানা প্রজাতির ফুলের সমরোহ এবং সুগন্ধে দর্শকদের আকুল করে সারা বছর। শীতকালে এখানে হাজারো চেনা অচেনা ফুলে ফুলে প্রজাপতির মেলা বসে। সৌখিন ফটোগ্রাফারদের জন্য চমৎকার এক লোকেশন। দর্শনার্থীদের জন্য আছে কয়েকটি আকর্ষনীয় দোলনা এবং মাছ, পাখি, জীব-জন্তুর কৃত্তিম চিড়িয়াখানা। এছাড়াও বিশাখা সাগরে আছে নৌভ্রমনের জন্য অন্যতম আকর্ষণ সোনার তরী এবং সপ্তডিঙ্গা। অপরুপ স্থাপত্য আধুনিক শহীদ মিনার আপনাকে সামান্য সময়ের জন্য হলেও স্থম্ভিত করে দিবে।

অপরুপ সাঁজে সাজানো এই জমিদার বাড়িতে প্রায় প্রতিদিনই চলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পিকনিক এবং বিভিন্ন নাটক বা ছবির শুটিং। ব্যবস্থাপনার স্বার্থে এখানে প্রবেশের শুভেচ্ছা মূল্য মাত্র ২০ টাকা করা হলেও সময় পরিক্রমায় তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে বর্তমানে ১০০ টাকায়। আলোচনা সাপেক্ষে পিকনিক বা শুটিং স্পট ভাড়া দেওয়া হয়। আর খাবার ও পানীয়ের জন্য আছে ক্যান্টিন সুবিধাও। আগেই অর্ডার দিলে আপনার পছন্দের মেনু অনুযায়ী যে কোন খাবার সরবরাহ করা হয়। তাহলে আর দেরী নয় চলুন আজই ঘুরে আসি মহেড়া জমিদার বাড়ি থেকে। ও আপনি যদি জমিদার বাড়িতে পূর্ণিমা স্নান বা রাত্রী যাপন করতে চান তার জন্য এসি/নন এসি ডাক বাংলোর সুব্যবস্থা রয়েছে। খুব সকালে এবং বিকেলে দেখতে পাবেন পুলিশের মাঠ প্রশিক্ষণ কসরত।

যেভাবে যেতে হবে- ঢাকা থেকে টাঙ্গাইলগামী বাসে জামুর্কী ও নাটিয়াপাড়া বাসষ্ট্যান্ডের মধ্যবর্তী ‘পুলিশলাইন’ নেমে অপেক্ষমান সিএনজি বেবী টেক্সিযোগে (জন প্রতি ১৫-২০ টাকা) ৩ কিলোমিটার পূর্ব দিকে মহেড়া জমিদার বাড়ি।

মহাসড়কে পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার, মহেড়া, টাঙ্গাইল নামে দিক নির্দেশনা ফলক (বিশাল সাইনবোর্ড) আছে। আর যারা উত্তরবঙ্গ থেকে আসবেন তারা যে কোন ঢাকাগামী বাসে টাঙ্গাইল পার হয়ে ৮-১০ কিলোমিটার পর ‘পুলিশলাইন’ নেমে একইভাবে যেতে পারেন।

বিডি/এন

শেয়ার করুনঃ
Advertisement