নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি কুয়াকাটা

নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি কুয়াকাটা

সৈয়দ জাফরান হোসেন নূর

Published : ১৪:৫৭, ১৫ জুলাই ২০২৪

নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি সাগরকন্যা খ্যাত কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত। সাগরের বিশালতা মানুষকে সব সময় কাছে টানে। পৃথিবীর প্রায় সবাই সমুদ্রের পাশে সময় কাটাতে পছন্দ করেন। কবি সাহিত্যিকগণ সমুদ্রকে নিয়ে যুগে যুগে অনেক সুন্দর সুন্দর উক্তি এবং বাণী করে গেছেন। শীতকালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে এখানে অতিথি পাখি আসে। ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ বাংলাদেশের এই সাগর সৈকত থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করা যায়। সৈকতের পূর্ব প্রান্তের গঙ্গামতির বাঁক থেকে সূর্যোদয় ভালোভাবে দেখা যায়। আর সূর্যাস্ত দেখার ভাল জায়গা হচ্ছে কুয়াকাটার পশ্চিম প্রান্ত।

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের স্থানাঙ্ক ২১ক্ক৪৯′১৬″ উত্তর ৯০ক্ক০৭′১১″ পূর্ব বরিশাল বিভাগের পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার লতাচাপলী ইউনিয়নের শেষ প্রান্তে অবস্থিত সাগরকন্যা খ্যাত কুয়াকাটা। এখানে রয়েছে- মৎস্য-শিকার, কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে সূর্যাস্ত, বৌদ্ধ মন্দির, সমুদ্রতীর, ম্যানগ্রোভ বন (ফাতরার বন- সমুদ্রসৈকতের পশ্চিম দিকের সংরক্ষিত ম্যানগ্রোভ বন, যা ‘দ্বিতীয় সুন্দরবন’ হিসেবে পরিচিত), তিন নদীর মোহনা, লেম্বুসের চর সহ নানা দর্শনীয় স্থান।

ভ্রমণ পিপাসু পর্যটকদের আনন্দ ও অবকাশ সময় যাপনের অন্যতম মনোরম ও মন-মুগ্ধ কর জায়গা হচ্ছে কুয়াকাটা। শুধু দেশেই নয়, এখন বিশ্বজুড়ে কুয়াকাটার পরিচিতি। বেলাভূমির একই স্থানে দাড়িয়ে সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের বিস্ময়কর মনোরম দৃশ্য দেখার সমুদ্র সৈকত। নজরকাড়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে কুয়াকাটার রয়েছে আলাদা সুখ্যাতি।

সাগরকন্যা কুয়াকাটা হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় তীর্থস্থান। অগণিত ভক্তরা এখানে ‘রাস পূর্ণিমা’ এবং ‘মাঘী পূর্ণিমা’ উৎসবে মিলিত হন। এই উপলক্ষে তীর্থযাত্রীরা উপসাগরে পবিত্র স্নান করেন এবং ঐতিহ্যবাহী মেলায় অংশ নেন। সমুদ্র সৈকতের পাশে অবস্থিত ১০০ বছরের পুরনো বৌদ্ধ মন্দিরে গৌতম বুদ্ধের মূর্তি এবং দু’টি ২০০ বছরের পুরানো কূপ রয়েছে।

জানা যায়, কুয়াকাটা নামটি আরকানদের সাথে জড়িত। এর পুরো ইতিহাসের রয়েছে আরাকানদের এদেশে আগমন নিয়ে। ‘কুয়া’ শব্দটি অর্থ ‘কূপ, মুল কূপের ধারণা থেকে কুয়া শব্দের উৎপত্তি। ধারণা করা হয়, ১৮ শতাব্দীতে মুঘল শাসকদের দ্বারা বার্মা (বর্তমান মায়ানমার) থেকে বিতাড়িত হয়ে আরাকানরা এই অঞ্চলে এসে প্রথম বসবাস শুরু করেন। সে সময় এ এলাকায় সুপেয় (পানের জন্য যে পানি) পানির অভাব পূরণ করতে তারা প্রচুর কুয়ো বা কূপ খনন করেছিলেন, সেই থেকেই এই অঞ্চলের নাম হয়ে যায় কুয়াকাটা!

বিগত ২০২৩ সালের ৩ ও ৪ ফেব্রুয়ারি প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের (পিআইবি) গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতা বিভাগের মাস্টার্স ২য় ব্যাচের শিক্ষার্থীরা সাগর কন্যা কুয়াকাটায় শিক্ষা সফরে এসেছিলেন। শিক্ষা সফরের জন্যে রাজধানী ঢাকা থেকে কুয়াকাটার উদ্দেশ্যে বাসে রওনা দেন। বাসটি পদ্মা সেতুর মূলপ্রান্ত থেকে ওপার প্রান্তে যেতে মাত্র ৯ মিনিট সময় নেয়। শহরে এতো সুন্দরভাবে একটা গ্রাম্য পরিবেশের ছোঁয়া লেগেছে যা দেখে সবাই অভিভূত।

শিক্ষার্থীরা কুয়াকাটার লেম্বুস বাগান, ত্রিমোহনা, কাঁকড়ার বিচ, শুঁটকি পল্লী ভ্রমণ করে। শুঁটকি পল্লীতে বেশ কয়েকটি শুঁটকির দোকান রয়েছে। পাশেই প্রাকৃতিকভাবে মাছ শুকানো হচ্ছে। এরপর সেখান থেকে সমুদ্রের পাশ দিয়েই লেম্বুসের বাগানে প্রবেশ করে শিক্ষা সফরের দলটি।

পিআইব’র শিক্ষার্থীরা হোটেলে রাত যাপন করে ভোর হবার আগেই উঠে সূর্যোদয় দেখতে অটোরিকশা যোগে রওনা দেয়। সৈকতের পার ঘেঁষে মেরিন ড্রাইভ রোড দিয়ে বহনকারী যানটি চলছিল। ভোরের সৈকতের হিমেল হাওয়া, শরীরে শীতের জানান দিচ্ছে বারবার। অবশেষে সেই মোহনায় পৌঁছে সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় ঢাকা থেকে যাওয়া শিক্ষার্থীরা। কুয়াশার কারণে বেশ দেরি করতে হয়। খানিকটা সময় পর পূর্ব দিগন্তে রক্তলাল আভা দেখা দেয়। এরপর আস্তে আস্তে পৃথিবীকে উষ্ণ করতে উদিত হয় উত্তপ্ত সূর্য।

কুয়াকাটা সাগর সৈকতের স্থলভাগ খুবই মনোরম। সৈকত থেকে দেখা মেলে গাংচিল ঝাঁক। সমুদ্রের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন করতে ট্রলারযোগে ফাতরার বনে পৌছে। জানা যায়, সমুদ্র সৈকতের পশ্চিম দিকে ম্যানগ্রোভ বন, যার নাম ফাতরার বন। সংরক্ষিত বনভূমি ফাতরার বন ইতোমধ্যে দ্বিতীয় সুন্দরবন হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে। এখানে রয়েছে কেওড়া, গেওয়া, সুন্দরী, ফাতরা, গরান, বাইন, গোলপাতা ইত্যাদি ম্যানগ্রোভ প্রজাতির উদ্ভিদ।

স্থানীয়রা, সব সময় প্রচুর পর্যটকের আনাগোনা দেখা যায় সাগরকন্যাকে ঘিরে। তবে শীতকালেও  অবকাশ কাটাতে বেশি মানুষ এখানে ছুঁটে আসে। এ সৈকত তাদের জীবিকার অন্যতম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সাগরকন্যার রূপ আর লীলাভূমি অবলোকন করতে আসা দর্শনার্থীরা জানান, কুয়াকাটা বিভিন্নভাবে উপযোগী হয়ে উঠতে পারেনি। কারণ খাবার মানসম্মত নয় বরং হোটেল মালিকরা অতিরিক্ত টাকা নেয়। স্থানীয় ও হোটেলের কর্মকর্তারা নানা সিন্ডিকেট করে। নানাভাবে প্রতারণার ফাঁদ পেতে থাকে।

তারা আরও জানান, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা, সৈকতের সঠিক রক্ষণাবেক্ষন, আবাসন ও হোটেল উন্নয়ন, রাস্তাঘাট সংস্কার ইত্যাদি কার্যক্রমের উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলেই ‘সাগরকন্যা’ হবে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের জন্য অন্যতম সম্ভাবনাময় স্থান।

প্রসঙ্গত, কুয়াকাটায় সূর্যোদয় দেখার জন্য ঝাউ বনে যাওয়াই ভালো। সেখান থেকেই সূর্যোদয় ভালো দেখা যায়, সমুদ্রের বুক চিড়ে কিভাবে সূর্য উঠে তা দেখার জন্য অনেক লোকই আগে চলে যায় সেখানে। সকাল বেলা হেটে হেটে ঝাউ বনে যেতে ২০ মিনিট সময় লাগবে। আর ভ্যানে বা মোটরসাইকেলযোগে গেলে অল্প সময়ে যাওয়া যায়। সেখানে সারি সারি ঝাউ গাছ নিঃসন্দেহে সুন্দর।

এই বনটি সরকার বনায়ন পরিকল্পনার অধীনে তৈরি করেছে। সূর্যোদয়ের চেয়ে সূর্যাস্তের দৃশ্যটা বোধহয় বেশি চমৎকার। সূর্যটা সমুদ্রে ডুবে যাওয়ার সময় রংয়ের পরিবর্তনটা আপনি স্পষ্টই দেখাতে পাবেন। কুয়াকাটা সৈকতের যেকোন প্রান্ত থেকে সূর্যাস্ত দেখা যায়। তবে দৃষ্টিনন্দন সূর্যাস্ত দেখার জন্য পর্যটকরা ভিড় জমান কুয়াকাটা সৈকতের পশ্চিম প্রান্ত ‘লেবুর বনে’।

লেখক: শিক্ষার্থী

মাস্টার্স দ্বিতীয় ব্যাচ

গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতা বিভাগ

প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)

বিডি/এন

শেয়ার করুনঃ
Advertisement